কোচিং, শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা - দৈনিকশিক্ষা

কোচিং, শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বাধা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এসএসসি পরীক্ষা শেষের পথে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। গেলবার এইচএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে দেশের সব কোচিং সেন্টারকে ১ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সব কোচিং সেন্টার সেই নির্দেশ মেনে তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে এমন খবর নিশ্চিত করে বলা যায়নি। সারা বছর শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠদান থেকে বিরত থেকে যে কোচিং নির্ভরতার বেড়াজালে আটকে পড়েছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা তা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। কোচিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণের প্রবণতায় যদি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একজোট হন তাহলে শুধু আইন বা বিধিনিষেধ আরোপ করে কোচিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। আড়ালে-আবডালে কোচিংয়ের বীজ ডালপালা ছড়াবেই। এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বছরই কিছু না কিছু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে নিঃসন্দেহে। মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এইচএসসি পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীদের জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচনা করা হয়। এই পরীক্ষার ওপরই নির্ভর করে একজন শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ। এইচএসসি ও এসএসসি দুটো পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা পাবলিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু পর্যবেক্ষণ বলছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাদের অনেকেই উত্তীর্ণ নম্বরই পান না। এ থেকে স্কুল ও কলেজের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মান নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আর এজন্য শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতাকে দায়ী করাটা একবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

শিক্ষার্থীদের কোচিং অনুগামী হওয়ার জন্য শিক্ষকের দায় রয়েছে। পুরনো দিনে শিক্ষকতা পেশায় যারা আসতেন তারা ছিলেন বিদ্যানুরাগী। শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণের জন্য তারা নিজের সব ভোগ-বিলাস ত্যাগ করতেন। বেশি দিন আগের কথা নয়, আমরা যারা পঞ্চাশের দশকে স্কুলে পড়েছি তখনো শিক্ষকদের মাঝে এ ধরনের মনোভাব লক্ষ করেছি। সেই সময়ের শিক্ষকরা ছিলেন পিতৃতুল্য। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে তারা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন। শ্রেণিকক্ষে এমনভাবে পাঠদান করতেন, যার ফলে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীকে খুব একটা পড়তে হতো না। প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে শিক্ষকের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া যেত। ক্লাসের বাইরে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চার মাঝে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষাদান ও মানবিক গুণাবলি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতেন। হঠাৎ কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের মাথায় কোচিং নামক ভ‚ত চাপিয়ে দেয়া হলো। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে তাদের ছুটতে হলো কোচিং আর প্রাইভেট পড়ার দিকে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেল। এই সুযোগে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠলো কোচিং সেন্টারগুলো। শিক্ষায়তনের লেখাপড়া চলে গেল কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট টিউটরের বাড়িতে। স্কুল ছেড়ে শিক্ষার্থীদের বাসায় লেগে গেল প্রাইভেট টিউটরের ভিড়। সারা দিন কোচিং সেন্টারে ছুটতে ছুটতে কোমলমতি কিশোরদের শৈশব-কৈশোর কোথায় হারিয়ে গেল। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের কাছে ব্যাচ ধরে প্রাইভেট ও কোচিং করতে শুরু করল। শিক্ষাদানের নামে কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতে শুরু করল বিপুল পরিমাণ অর্থ। কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত একেকজন শিক্ষক হলেন বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধিকে হয়ে গেল সীমাবদ্ধ। একজন শিশু যার অক্ষরজ্ঞানই হয়নি তাকে পাঠানো শুরু হলো কোচিং সেন্টারে। সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠানো আজ বাবা-মায়ের কাছে যেন এক ধরনের বিলাসিতায় পরিণত হলো। এভাবে শিক্ষার নামে বাণিজ্যের পরিধি বাড়তে বাড়তে দেশে বর্তমানে আজ কোচিং সেন্টারের সংখ্যা পৌনে ২ লাখের বেশি। সাধারণত স্কুল-কলেজে চাকরিরত শিক্ষকরা এসব কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেন। অনেক শিক্ষক বাসায় নিয়মিত ব্যাচ করে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান। আর এই কোচিং বাণিজ্য থেকে অবৈধভাবে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা আয় হয়। কোচিং সেন্টারে লেখাপড়ার মতো যন্ত্রনির্ভর ব্যবস্থায় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা, জিপিএ ৫ পাওয়া সহজ হয়ে গেছে। যত বেশি শিক্ষকের কাছে কোচিং করা, তত বেশি ভালো ফলাফল এটাই যেন আজ নিয়ম হয়ে গেছে। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যন্ত গাঁয়ের কোনো স্কুলের কৃষক-শ্রমিকের সন্তানের পক্ষে খুব একটা ভালো ফলাফল করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কোচিং সেন্টারনির্ভর শহরকেন্দ্রিক লেখাপড়া ধীরে ধীরে বিত্তশীলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। তাই রাজধানীর স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মফস্বল শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র অতি সহজেই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। ছেলেমেয়েরা এসব প্রশ্নের উত্তর রাত জেগে আওড়িয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে উগরে দেয়। কাজেই পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ের ব্যাপারটি হচ্ছে উপেক্ষিত। দিন দিন শিক্ষার মানও যাচ্ছে নেমে।

ক্লাসরুমে পড়ানোর ব্যর্থতার কারণে কোচিং সেন্টারে বাণিজ্য হচ্ছে, তাই কোচিং বাণিজ্যকে নতুন ধরনের অপরাধ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের করা নীতিমালা-২০১২কে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। এছাড়া অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য নীতিমালা-২০১২ অনুযায়ী নীতিমালা ভঙ্গের অপরাধে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত রাখার বিধানও রাখা হয়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তা অসদাচরণ হিসেবে সরকারি চাকরি বিধিমালা, ১৯৮৫-র অধীনে শাস্তিযোগ্য বলে গণ্য করা হবে। নীতিমালা জারির শুরুর দিকে কড়াকড়ির কারণে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হলেও আবার তা পুরো দমে শুরু হয়। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসেনি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে যে কোনো মূল্যে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কোচিং বাণিজ্যকে সমূলে বিনাশ করা ছাড়া দেশে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যাবে না। পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষাদান পদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। সারাদেশের শিক্ষার মানের সমতা বজায় রাখতে মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষায়তনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, উচ্চশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারা নিয়মিত পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা ও তাদের পাঠগ্রহণের সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষককে পাঠ্য বিষয়ের বিন্যাস করতে হবে। নোটবই ও গাইড বইয়ের বিস্তার রোধ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি মা-বাবা, অভিভাবকের হতে হবে যত্নশীল। তাদের সন্তানরা যেন কোনোমতে কোচিংয়ের ফাঁদে পা না দেয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সন্তান সুশিক্ষায় গড়ে না উঠলে জীবনের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশার প্রতি সর্বস্তরের শিক্ষকদের হতে হবে শ্রদ্ধাশীল। নির্লোভ, যোগ্যতাসম্পন্ন, অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা শ্রেণিকক্ষে সুষ্ঠু পাঠদান নিশ্চিত করতে পারলে কোর্চিং বাণিজ্যের প্রবণতা দূর হবে। শিক্ষাঙ্গনে সুবাতাস বইতে শুরু করবে।

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ : কলাম লেখক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039269924163818