কোটা নিয়ে কূটকৌশল - Dainikshiksha

কোটা নিয়ে কূটকৌশল

আমিরুল আলম খান |

টি এস এলিয়ট এপ্রিলকে বলেছিলেন ‘ক্রুয়েলেস্ট মন্থ’—ক্রুরতম মাস। বাংলাদেশে এবার এপ্রিল মাসটা তেতে উঠেছিল। সারা দেশে রাজপথে নেমে এসেছিলেন ছাত্ররা। তাঁদের দাবি, সরকারি চাকরিতে ‘কোটাপ্রথা’ সংস্কার করতে হবে, কোটা ৫৬ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আর সে দাবির প্রতি সারা দেশের সব শ্রেণির মানুষের সাড়াও ছিল। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে মোট ২৫৮ ধরনের কোটা রয়েছে (আকবর আলি খান, প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০%, জেলা ১০%, নারী ১০%, উপজাতি ৫% এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১%। মোট ৫৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম—সব ধরনের স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁরাই অগ্রসেনা। এবারের আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু যে প্রাবল্যে এবং দ্রুততায় মাত্র তিন দিনে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, তাতে অনেকেই অবাক হয়েছে। গভীর রাতে হল থেকে ছাত্রীরা বেরিয়ে এসে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। এ এক অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়; কিন্তু এবার তাঁরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হবে বলেই সবাই বিশ্বাস করে।

সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে তেলেসমাতি চলছেই। ‘মেধা বনাম কোটা’ বিতর্ক নতুন নয়। বলতে গেলে, সেই সত্তর দশক থেকেই কোটা সংস্কারের সুপারিশ সরকারের টেবিলে। কোটার ভালো–মন্দ দুটি দিকই আছে। কিন্তু কোটা যখন মেধাকে অতিক্রম করে (এ ক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ), তখন মেধা পরাস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর রাষ্ট্র যদি মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, তবে ন্যায়বিচার, সুশাসন ও সাফল্য অর্জনও দুরূহ হয়ে উঠবে। তাই কোটার ন্যায্য সংস্কারের দাবি অনেক দিনের।

লক্ষণীয়, কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু পুলিশের একটি বাহাদুরি দেখানোর বাতিক থাকেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলনে লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস ছোড়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে গুলির ঘটনায় আরও ক্ষুব্ধ হন তাঁরা। কারা সে গুলি ছুড়েছে? হতাহত নিয়ে গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় ন্যক্কারজনক হামলা হলো। সেটি কারা করল, কেন করল, তা এখনো জানা যায়নি। এই নিন্দনীয় হামলার পেছনে কাদের ইন্ধন ছিল, তা নিয়ে নানা কথায় বাজার সয়লাব।

আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের দাবি জানালে কিছু লোক তাঁদের ‘রাজাকার’ বলে গালাগাল করলেন। আন্দোলন করলেই কি কেউ রাজাকার হয়ে যাবে? আন্দোলনকারীরা তো সরকারবিরোধী কোনো স্লোগান দেননি। বরং তাঁরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বৈষম্যহীন-ব্যবস্থার পক্ষেই দাবি করছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে।

বোঝা যাচ্ছে, যেকোনো ‘যুবকম্পে’ ভীত সরকার। তাই এমন বেসামাল উক্তি কিছু নেতা-নেত্রীর। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে সংসদে প্রধানমন্ত্রী ‘কোটাব্যবস্থাই তুলে দেওয়ার ঘোষণা’ দেন। তাতে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে বটে, কিন্তু সমস্যার মীমাংসা হয়নি। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশে কোনো রাখঢাক ছিল না এবং তিনি জানতেন, কোটা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার ঘোষণায় সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা মানবে না। তারাও রাজপথে নেমে আসবে। তখন কোটা সংস্কারপন্থী এবং কোটা রক্ষাকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে।

আন্দোলনকারীরা বোধ হয় তা আগেই টের পেয়েছিলেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় তাঁরা খুশিতে গদগদ হননি, বিভ্রান্তও হননি। তাঁরা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করে গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু ১৬ এপ্রিল ১৬ তিন আন্দোলনকারীকে দুপুরবেলা জোর করে তুলে, চোখ বেঁধে গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় পরিস্থিতি নতুন মোড় নিতে পারে। ক্ষমতাসীনেরা কোটা আন্দোলনে রাজনীতির গন্ধ শুঁকছেন। তাঁদের কাছে ‘রাজাকারতত্ত্ব’ প্রধান হয়ে উঠছে, আর ন্যায্যতার প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা একবার যে দাবির ন্যায্যতা মেনে নিয়েছেন, তা থেকে সরে যাওয়ার আলামত কি এসব? নইলে বিভিন্ন জায়গায় কার ইন্ধনে কোটা আগের অবস্থায় পুনর্বহালের দাবি উঠছে?

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে বেকার যুবকের সংখ্যা ২৬ লাখ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার প্রায় আড়াই লাখ। তাঁরা সবাই যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ চান। তাঁরা যখন কাজ খুঁজে খুঁজে হয়রান, তখন আমাদের শ্রমবাজারে অনেক বেশি বিদেশির অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।

কোটা নিয়ে রাজনীতি ছিল, আছে। হয়তো থাকবেও। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন যুবশক্তির যে উত্থানের বার্তা দিয়েছে, তা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বেকার উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা, যাঁরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। সে যুবশক্তিকে যদি কাজ দেওয়া না যায়, তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সাফল্য আছে; কিন্তু ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে আমরা কতটুকু সাফল্য দেখাতে পারব, তা নিয়ে উন্নয়নবিশারদদের সংশয় প্রচুর। জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় সংখ্যাগত সাফল্য অর্জনই ছিল আসল কথা। কিন্তু এবার করতে হবে গুণগত লক্ষ্য অর্জন, যেটা অনেক অনেক কঠিন। সুশাসনে মেধার বিকল্প নেই; আর সুশাসন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। এ বাস্তবতা মেনেই আমাদের কোটা সংস্কার করতে হবে, বিলুপ্ত নয়। আর ন্যায়সংগত আন্দোলনকারীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে এখনই।

আমীরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

সূত্র: প্রথম আলো

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069460868835449