প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির কোটা পদ্ধতি সংস্কার হবে না বাতিল হবে তার সিদ্ধান্ত হবে আজ বুধবারের (৩ অক্টোবর) মন্ত্রিসভা বৈঠকে। কোটা সংস্কার বা বাতিল সংক্রান্ত সচিব কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কোটা সংক্রান্ত সচিব কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে তাঁর তেজগাঁও কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমানকোটা পদ্ধতি সংস্কার/বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন’ শিরোনামের একটি এজেন্ডা থাকতে পারে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সচিব কমিটি নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরির সব ধরনের কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার পর কোটা পদ্ধতি বাতিলের ফলাফল বা প্রভাব বিশ্লেষণ করার সুপারিশও করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে কোটা সংক্রান্ত সচিব কমিটি নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা নিয়ে সাত দফা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
নারী কোটার বিষয়ে সচিব কমিটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেছে। এসএসসি, এইচএসসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ায় মেয়েরা এখন ছেলেদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়েও মেয়েরা ভালো ফল করছে। চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে সচিব কমিটি বলেছে পাসের হারের ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। এবছর এসএসসিতে ছেলেদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। অথচ মেয়েদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এইচএসসিতে ছেলেদের পাসের হার ৬৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং মেয়েদের ৬৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেয়েরা বিগত সময়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করছে। বর্তমানে নারীদের স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে করে সমাজে ধীরে ধীরে নারীদের অবস্থান বদলাচ্ছে। নারীদের শিক্ষা গ্রহনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এর প্রমান তুলে ধরার জন্য কমিটি ১৯৭৫-৭৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষা, নিম্ন-মাধ্যামিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ও মদরাসা শিক্ষার পরিসংখ্যানের সঙ্গে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে কমিটি বলেছে আগে মেয়েরা পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষানীতির কারণে গত এক দশকে ছেলেদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে তারা ছেলেদের চেয়ে ভালো অবস্থা রয়েছে।
সচিব কমিটি অন্য এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, নবম থেকে ১৩ গ্রেডের গেজেটেড পদে ১০ শতাংশ জেলা কোটা রয়েছে। জেলার জনসংখ্যারভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট জেলা কতটি পদ পাবে তা নিধারণ করার জন্য এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এরফলে শূন্য পদের সংখ্যা কম হলে বেশি জনসংখ্যার জেলাগুলোর প্রাপ্য পদ পূর্ণ সংখ্যায় পাওয়া গেলেও কম জনসংখ্যার জেলার প্রাপ্য পদ ভগ্নাংশের হয়। এতে বেশি জনসংখ্যার জেলার প্রার্থীরাই শূন্য পদে বেশি নিয়োগ পায়। কম জনসংখ্যার জেলাগুলো কম সুবিধা পায়। জেলা কোটা সব জেলা থেকে সুষম নিয়োগের জন্য করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
গত ১০টি বিসিএসের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে সচিব কমিটির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৭তম বিসিএস পর্যন্ত কোনটিতেই ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হয়নি। সর্বোচ্চ ১২ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী পাওয়া গেছে ৩১তম বিসিএসে। এরপরই ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া গেছে ৩৭তম বিসিএসে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সবচে কম প্রার্থী পাওয়া গেছে ৩৬তম বিসিএসে। ওই বিসিএসে প্রার্থী পাওয়া গেছে মাত্র সাত দশমিক ছয় শতাংশ। সাত দশমিক ৭৭ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া গিয়েছিল ৩৫তম বিসিএসে। ৩২তম বিসিএস ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিশেষ বিসিএস। ওই বিসিএসেও মাত্র ৪৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
নারী কোটায়ও ১০ শতাংশ প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। গত ১০টি বিসিএসের মধ্যে নারী কোটায় সর্বোচ্চ নয় দশমিক শূন্য এক শতাংশ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল ৩৭তম বিসিএসে। নারী কোটায় সবচে কম প্রার্থী পাওয়া গেছে ২৯তম বিসিএসে। ওই বিসিএসে মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ নারী প্রার্থী চাকরি পেয়েছিল।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ চাকরি দেওয়া হয়। অথচ গত ১০টি বিসিএসের কোনটিতেই দুই শতাংশ প্রার্থীও পাওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ এক দশমিক ১৭ শতাংশ প্রার্থী পাওয়া গেছে ৩৪তম বিসিএসে। আর কোন বিসিএসেই কোটার এক শতাংশও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় সবচে কম সংখ্যক চাকরি হয়েছিল ২৮তম বিসিএসে। ওই বছর মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সচিব কমিটি অন্য এক পর্যবেক্ষণে বলেছে সরকারি চাকরিতে কোটা অনুযায়ি পদ পূরণের বিষয়টি জটিল ও সময় সাপেক্ষ বিষয়। এই কোটার কারণে প্রার্থী নির্বাচন ও ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমান প্রচলিত কোটা প্রয়োগ পদ্ধতির সহজীকরণ অপরিহার্য।
সচিব কমিটি অপর এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল বা সংস্কারের দাবি উঠেছে। অনেকে কোটা যৌক্তিক পর্যায়েও নিয়ে আসার কথা বলেছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছে। তাছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সিভিল সার্ভিসের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে মেধা কোটা ৪৬ থেকে ৫৫ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে। তাছাড়া সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিযোগের ক্ষেত্রে মেধাবী প্রার্থীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার জন্য কোটা পদ্ধতির আরো সংস্কারের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। উল্লেখ্য এই কমিশন ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাদের প্রতিবেদন তাৎক্ষণিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে দিয়েছিলেন।
সচিব কমিটি প্রথম পর্যবেক্ষণে কোটার ইতিহাস তুল ধরে বলেছে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ সর্বশেষ কোটা নির্ধারণ করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধার জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটায় মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে পাওয়া না গেলে পুত্র-কন্যার পুত্র কন্যাদের অন্তর্ভূক্ত করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটার মধ্যে পর্যাপ্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই কোটা থেকে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করার বিধান করে। এছাড়া নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৫ শতাংশ প্রার্থীকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি নিয়োগ করা হয়।