সোনাগাজীর রাফি নামের মেয়েটি, মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, ঝলসে মরলো লালসার শিকার হয়ে আপন শিক্ষকের—যার হওয়ার কথা ছিল রক্ষক। মেয়েটি মরলো প্রতিবাদ করে সাহসিকতার সঙ্গে, আপস না করে অন্যায়ের সঙ্গে। অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। অবাক করা বিষয়, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে প্রথমে এগিয়ে আসেনি মেয়েটির এলাকাবাসী। ভয়ে নাকি আতঙ্কে, নাকি এমনতরো নির্যাতন গা-সয়ে-যাওয়া বিষয় হয়ে যাওয়ার কারণে? আমরা সমাজের মানুষগুলো কি হয়ে যাচ্ছি অনাচারপ্রুফ? খাপ খাইয়ে নিচ্ছি আমরা অনাচার-অন্যায়-ব্যভিচারের সঙ্গে? তবে সমগ্র দেশ জেগে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে সাহসী আর সাহসিকারা, অন্যায় সহ্য-না-করা মানুষেরা। এ জাগরণ জিন্দা থাকুক চিরকাল।
রাফির আগেও অনেক ঘটনা ঘটেছে একই রকমের। হয়তো প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন, ভিন্ন ছিল ঘটনার ধরন। তবে সর্বত্র অনাচারের স্বরূপ এক, অভিন্ন। শিক্ষকের হাতে ছাত্রী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা একটি দুটি নয়, অনেক। প্রতিবছর প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় উঠে আসে এসব বর্বর ঘটনা। এক হিসাবে, পাঁচ বছরে সহস্রাধিক ছাত্রী শিক্ষকের লালসার শিকার হয়েছে। যেখানে মিডিয়ার উপস্থিতি নেই, সেসব স্থানের ঘটনাগুলো তো থেকেই যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। যা কিছু আসে নজরে, তাতেই তো থমকে যেতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন এমন অবস্থা? এটা বোঝার জন্য কি সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রয়োজন? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না কেন এসব ঘটছে? কারণ অনেক। প্রথমত, জানোয়ারের মনোবৃত্তি নিয়ে জন্ম নেয়া কিছু অমানুষ মানুষের রূপ ধারণ করে স্কুল-মাদ্রাসা খুলে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠান-প্রধানের পদ ‘অলঙ্কৃত’ করছে।
তারপর রং বদেল নিচ্ছে, সমাজের মাথা হয়ে উঠছে, ঘাপটি মেরে থাকা দুর্বৃত্তদের সাথে মিলেমিশে সমাজে পচন ধরাচ্ছে, অসত্ পথে অর্জিত সম্পদ দিয়ে সমাজপতিদের কিনে নিচ্ছে আর সমাজকে প্রতিনিয়ত ধোঁকা দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সমাজের ‘ভালো’ মানুষগুলো মিইয়ে যাচ্ছে। তারা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, দুর্বৃত্তপনা করে দুর্বৃত্তরা যে ক্ষতি করে তার চেয়ে ভালো মানুষেরা চুপ থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে। ভালো মানুষদের নিশ্চুপতা সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে, দুর্বৃত্তরা আরো বেশি করে অন্যায়-অনাচার করার সাহস পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনাচার হলে তা সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। তৃতীয়ত, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিলম্বিত বিচার অপরাধীদের আরো বেপরোয়া করে তোলে। চতুর্থত, অনাচার-বখাটেপনা বন্ধে সমাজের নিষ্ক্রিয়তা আরো সাহসী করে তুলছে দুর্বৃত্তদের।
একদিকে দুর্বৃৃত্তায়িত শিক্ষক, আরেকদিকে বখাটে-মাস্তানরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন। কখনো আসা-যাওয়ার পথে, কখনো বাসগৃহে, কখনো বাস-লেগুনায়, কখনো আত্মীয় বাড়িতে—হামলা হচ্ছে সর্বত্র। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসের প্রথম ১৫ দিনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে শিশু পড়ুয়াসহ ৪৭ জন। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণের দিনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে নয়জন। আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে শিশু আর ছাত্রীসহ নারী নিপীড়ন। নিরাপত্তা নেই নারীর কোথাও। সবখানে হা করে আছে বিকৃত রুচির অসুর। কর্মস্থলে তো নয়ই, এমনকি আপনগৃহেও ভালো নেই আমাদের মায়েরা, কন্যারা, বধূরা। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৯’-এর তথ্যানুযায়ী, জীবনসঙ্গীর সহিংসতার শিকার হয় ৭২.৬ শতাংশ নারী। কী ভয়ংকর খবর, তা কি অনুধাবন করতে পারছি আমরা? একদিকে নারীকে শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আরেকদিকে তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না; প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছি নির্মমতার দিকে। এ দ্বৈত-চরিত্র আমাদের বদলাবে কবে?
চিহ্নিত নিপীড়নকারী আর বখাটেদের কি দ্রুত বিচার হয়েছে? বখাটেদের উত্ত্যক্ততায় আত্মহত্যা করে মা-বাবার কোল খালি করে চলে গেলো বাগেরহাটের মুক্তবাংলা চারিপল্লী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীম; বরিশাল এবিআর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী লিয়া; তনু, মিথিলাদের কথা তো বহুবারই উচ্চারিত হয়েছে। ভিকারুন্নেছা স্কুলের শিক্ষক পরিমল আর কুষ্টিয়ার পান্না মাষ্টারের মতো দুর্বৃত্ত শিক্ষকের লাম্পট্যে সম্ভ্রম হারিয়েছে নাম-না-জানা বহু ছাত্রী। রাফির মতো তারা আগুনে ঝলসে মরেনি কিন্তু জীবন তো দিতে হয়েছে অনাচারীদের কারণে। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে যারা রাজনীতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে তারাই হয় এসব অনাচারের সঙ্গী। এরা কখনো শিক্ষক, কখনো সমাজসেবী, কখনো বা সরকারের হিতৈষী সেজে পদদলিত করে দিচ্ছে সমাজের শৃঙ্খলাব্যবস্থা আর মলিন করে দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের কৌলীন্য।
রাফির এলাকা সোনাগাজীর চিত্রও ভিন্ন নয়। ন্যায়বিচারের আশায় থানায় গিয়ে অপমানের শিকার হতে হয়েছে রাফিকে। বিপর্যস্ত মেয়েটির বক্তব্য ভিডিওতে ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে কলঙ্কিত করা হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি। স্থানীয় প্রশাসনও নির্লিপ্ত থেকেছে আর জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর যৌনহেনস্থা একটা অমার্জনীয় মারাত্মক অপরাধ সত্ত্বেও তারা ক্ষমতায় থেকেও নির্লিপ্ত থেকে আরো বড় অপরাধ করেছেন। প্রতিকারহীনতার প্রাবল্য আরো ভয়ঙ্কর করে তুলছে দুর্বৃত্তদের। রাফির ক্ষেত্রে দেখি, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আরো কয়েকটি ছাত্রীর সঙ্গেও অনৈতিক কাজ করে পার পেয়ে গেছে; অভিযোগ করার পরেও প্রতিকার হয়নি বরং সে বহাল তবিয়তে গদিতে সমাসীন থেকে হয়ে উঠেছে আরো বেপরোয়া। প্রতিকার তো হয়ই নি, বরং অধ্যক্ষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল তারই তৈরি সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র যারা চাপ দিচ্ছিল মেয়েটিকে মামলা প্রত্যাহারের। অবিচল প্রতিবাদী সাহসিকা মেয়েটি ঘৃণাভরা ক্রোধে জ্বলে ওঠায় মধ্যযুগীয় বর্বরতায় পুড়িয়ে মারলো তাকে। ঘটনার পর ঘাতকদের রক্ষায় আর ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠে একাধিক ‘গডফাদার’। এরাও অপরাধী, বড় অপরাধী। তাদেরও বিচার হতে হবে মূল অপরাধীর মতোই।
আমরা কোনোভাবেই দেখতে চাই না যৌন হয়রানি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যে স্থানটির হওয়ার কথা নিরাপত্তার অভয়ারণ্য। রক্ষক যেন কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে ভক্ষকরূপে। নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। কাউকেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না নীতিনৈতিকতার প্রশ্নে। আমরা আশান্বিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাফির ঘটনাটির সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন, সংশ্লিষ্টদের যথাযথ নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার ভাইকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়ে নির্যাতিতদের প্রতি সহমর্মিতার আরেকটি সুন্দর নজির সৃষ্টি করেছেন।
পাশাপাশি সমাজের বিশিষ্টজনেরা ‘গণভবন থেকে বঙ্গভবন’ পর্যন্ত মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা রুখে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। দুর্বৃত্তদের বুকে হিম ধরিয়ে দিতে হবে; সঠিক রাস্তায় না আসলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, যেভাবে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী আর জঙ্গিদের। শূন্য সহিষ্ণুতা চাই এক্ষেত্রেও। বিপুল উন্নয়ন, অগ্রগতি আর অর্জনগুলোকে মলিন করবে যারা অপকর্মের মাধ্যমে, আমরা চাই না বঙ্গবন্ধু আর তাঁরই কন্যার সোনার বাংলায় টিকে থাকুক এসব ঘৃণ্য অপরাধীরা। যতক্ষণ না দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে সকল প্রকার বর্বরতার, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নির্ভরতার জায়গাটা ফিরে পাবে না। ধর্ষক-অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার, ছাড় পাওয়ার কোনো জায়গা থাকুক বাংলাদেশে তা আমরা চাই না। আমরা কামনা করি, দ্রোহের আগুনে গণজোয়ার তৈরি হোক যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে।
আমরা কামনা করি, নিষ্ক্রিয় ডাকসু আগের মতো এগিয়ে এসে আন্দোলন-সংগ্রাম করুক সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত যৌন অপরাধসহ শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তিদানের বিরুদ্ধে। অবিরাম নৈতিক অপরাধ সমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, নষ্ট সমাজেই ভ্রষ্টতা বেশি। ভ্রষ্টতা যত বাড়বে, সর্বনাশ ততই জ্যামিতিক হারে ধেয়ে আসবে। শুধু বিলাপ আর কান্নাকাটি করে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। সময় এসেছে জ্বলে ওঠার। নির্লিপ্ত থাকার দিন শেষ। সময় এখন গর্জে ওঠার।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক