রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। বয়সের সাথে বেড়েছে সুনামও। কিন্তু সুনামকে পুঁজি করে যখন এক শ্রেণির শিক্ষক এবং গভর্নিং বডির সদস্য টাকা আয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত লাভের পথ খুঁজে নেন, তখনই ঘটে বিপত্তি। শিক্ষার মান হতে থাকে নিম্নগামী। শিক্ষকদের নৈতিকতায়ও পড়ে ভাটা। অরিত্রীর আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর আচরণের প্রমাণ মিলেছে। ২০১১ সালের পরিমল জয়ধরের অশুভ কাণ্ডের পরও কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক মান উন্নয়নে নজর দেয়নি, তারও প্রমাণ মিলেছে। অভিভাবকরা বলছেন, অনেক বাবা-মা এবং শিক্ষার্থীর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিনা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কিন্তু এই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে কিছু অর্থলোভী শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যের কারণে। তাদের অভিযোগ, ভিকারুননিসায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক রয়েছেন, যার মধ্যে হাতেগোনা কিছু শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনিতে জড়িত নন। বাকিদের ধ্যান-জ্ঞান স্কুলের বাইরে কোচিং-প্রাইভেট নিয়ে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মোটেই আন্তরিক নন। কোনো কিছুই শেখান না, শুধু হোম ওয়ার্ক দিয়ে দেন।
জানা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ, ভর্তি দুর্নীতি, কোচিং ও সেশন ফির নামে অভিভাবকদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায়, নিয়োগে অনিয়ম, কেনাকাটায় হরিলুট, নিম্নমানের সহায়ক বই শিক্ষার্থীদের গছিয়ে দিয়ে প্রকাশক প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন গ্রহণসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ভর্তি নীতিমালা, শাখা খোলার জন্য প্রণীত নীতিমালা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা, নিয়োগ নীতিমালার কোনোটাই মানে না গভর্নিং বডি। গত তিন দিন প্রতিষ্ঠানটির অন্তত ৫০ জন অভিভাবক এবং বিভিন্ন শ্রেণির ২০ জন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরিফুল নামে এক অভিভাবক বলেন, শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ানোতে মনোযোগী না। প্রাইভেট পড়ানোর জন্য নানাভাবে ইঙ্গিত দেন। একটু কিছু হলেই খারাপ ব্যবহার করেন। শুধু গণিত কিংবা ইংরেজি নয়- ধর্ম, আরবি ও চারুকলার মতো বিষয়েও ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে। তারা জানান, ব্যাচ-ভিত্তিক পড়ানো ও মডেল টেস্টসহ নানা নামে চলছে টিউশনি বাণিজ্য। এর বিনিময়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ১ থেকে ৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। এত টাকা নেয়ার পরও সপ্তাহে মাত্র তিন দিন পড়ান শিক্ষকরা। শুধু ভিকারুননিসার মূল শাখায় নয়- ধানমন্ডি, আজিমপুর এবং বসুন্ধরা শাখারও একই চিত্র ।
কাঠগড়ায় গভর্নিং বডি: অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত দলের প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির কিছু অনৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০৪ সালে হামিদা আলী নামে একজনকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে আর অধ্যক্ষ পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ও গভর্নিং বডির স্বার্থ উদ্ধারে ভর্তি বাণিজ্য ও নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ না দিয়ে তাদের মনোনীত এবং অনুগত ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বসিয়ে রাখছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতেও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যোগ্যদের বিবেচনায় আনা হয়নি।
কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি না মেনে চলতি বছরও দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করার অভিযোগ রয়েছে গভর্নিং বডির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সুপারিশের মাধ্যমে কিছু ভর্তি করা হলেও বাকিগুলো ভর্তির ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবক ও স্থানীয়রা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভর্তির আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি ভর্তি নীতিমালা জারি করে। এরপরও অযৌক্তিকভাবে সুপারিশের অজুহাত দেখিয়ে নীতিমালা অমান্য করে স্কুলগুলো। ভিকারুননিসা স্কুল ও তাই করেছে।
গত বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নিয়মের বাইরে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করে। স্কুলের জন্য একটা সংখ্যা নির্ধারিত আছে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর খবর নিয়ে জেনেছি যে, এখানে শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে ১০ লাখ টাকা লাগে। সেটা বন্ধ করার জন্য লটারি সিস্টেম চালু করি। দেখা গেছে, ভর্তির যে অনুমতি আছে এর চেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি করে ফেলে। এটা আরও বড় অনিয়ম। আমরা শাখার অনুমোদন দেই না, দেখা যায় তারা শাখা খুলে ফেলেছে।’
মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি গভর্নিং বডি। পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করেছে তারা। আত্মহত্যাকে জনশ্রুতি বলে উপহাস করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ পরিস্থিতে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এদিকে অভিভাবকরাও এই কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।