সম্মেলনের এক বছর পর গঠিত ও ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে যেমন অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও বিরোধ বাড়ছে, তেমনি এর জের ধরে ঘটছে নানা সহিংসতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ৩০১ সদস্যের কমিটিকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসবের মধ্যে একজন ছাত্রীনেত্রীকে অপহরণচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। সোমবার (২০ মে) দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইমাদ উদ্দিন মারুফ।
গত ১৩ মে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। একই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করতে যান। এ সময় সংগঠনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন নারীনেত্রীসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ১৫ মে বুধবার রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তারা ১৭ জন 'বিতর্কিত' নেতার একটি তালিকা প্রকাশ করে জানান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর শূন্য পদগুলোতে বঞ্চিতদের যুক্ত করা হবে। তবে পরদিন বৃহস্পতিবার পদবঞ্চিতরা মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে 'বিতর্কিত' ৯৯ নেতার নাম প্রকাশ করেন।
রাতের মারামারি : গত শনিবার রাত ১২টার দিকে 'বিতর্কিত' নেতাদের একটি তালিকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদবঞ্চিত ১০-১২ জনের একটি দল। উল্লেখ্য, শনিবার বিতর্কিত নেতাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও ১৩ মে মধুর ক্যান্টিনের ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ারও কথা ছিল।
আলোচনার সময় গোলাম রাব্বানী রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি বি এম লিপি আক্তারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চ্যানেলে তার বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথাবার্তা বলার অভিযোগ তোলেন। এ সময় লিপি জানান, সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে খারাপ কথা বলার মধ্য দিয়ে তারাই (বর্তমান নেতৃত্ব) এ শিক্ষা দিয়েছেন। অভিযোগ, তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে গোলাম রাব্বানী লিপি আক্তারকে মারধর করেন। সঙ্গে সঙ্গে তার অনুসারীরাও আলোচনায় অংশ নেওয়া পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতা-নেত্রীদের ওপর হামলা চালায়। টিএসসির ভেতর তাদের ওপর দুই দফায় হামলা করা হয়। পদবঞ্চিতদের দেওয়া তথ্যমতে, এ হামলায় তাদের ১৫ জনের মতো নেতা-নেত্রী আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন- নতুন কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক নিপু ইসলাম তন্বী, তিলোত্তমা শিকদার, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভীন ও সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, শামসুন নাহার হল শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা।
অবস্থান কর্মসূচি : ত্যক্ষদর্শীরা জানান, টিএসসিতে হামলার পর রাত ৩টার দিকে পদবঞ্চিতরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় তারা সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। তারা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টিএসসি থেকে বেরিয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে পদবঞ্চিতদের বুঝিয়ে অনশন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তবে পদবঞ্চিতরা তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মারধরের বিচার হওয়ার আশ্বাস না পেলে তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীসহ তাদের অনুসারীরাও সেখানে অবস্থান করেন। এ প্রতিবেদন লেখার সময়েও (রাত ৯টা) বঞ্চিতদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান করছিলেন।
এ প্রসঙ্গে পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বে থাকা গত কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু বলেন, তারা 'বিতর্কিত' ৯৯ জনের নামের তালিকা নিয়ে সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, ডেকে নিয়ে গিয়ে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তারা এ হামলার বিচার চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান।
রোকেয়া হলের সভাপতি বি এম লিপি আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তারা ১২ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চান। গোলাম রাব্বানী তাকে মারধর করেছেন- এ ঘটনাও তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন।
এ প্রসঙ্গে গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী সিন্ডিকেটের নির্দেশে নাটক সাজিয়ে ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে। কারও গায়ে হাত তোলা হয়নি।
ছাত্রলীগ নেত্রীকে 'অপহরণচেষ্টা' : এদিকে, পদবঞ্চিত ও হামলার শিকার রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশাকে অপহরণচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানায় গতকাল রোববার রাতে একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।
শ্রাবণী দিশা বলেন, বদরুন্নেসা কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি এস কে রিমা তাকে ফোন দিয়ে জানান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কথা বলতে চান। শনিবার সন্ধ্যায় রিমা হাতিরপুলের একটি বাসায় শ্রাবণী দিশার কাছে যান। কিন্তু রিমার আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন, নওফেলের কথা বলে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তার জেরার মুখে রিমা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যান। পরে তারা জানতে পারেন, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বর্তমানে চীনে অবস্থান করছেন। এ ঘটনায় শ্রাবণী দিশা শাহবাগ থানায় জিডি করেন। তার সঙ্গে তখন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীও ছিলেন।
এ সম্পর্কে বদরুন্নেসা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এস কে রিমা জানান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেল তার কাছে ফোন করে শ্রাবণী দিশার নম্বর চান। পরে শ্রাবণী তাকে ফোন করে হাতিরপুলের একটি বাসায় যেতে বলেন। সে অনুযায়ী তিনি সেখানে যান। শ্রাবণীর সঙ্গে তার স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়।
পদবঞ্চিতদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ : এদিকে, পদবঞ্চিত বিক্ষোভকারী নেতাদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠছে, তাদের কেউ কেউ বিবাহিত, কেউ চাঁদাবাজিতে যুক্ত, কেউ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত। কেউ আবার ছাত্রদলের সাবেক কর্মী। কেউ কেউ সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নানা অনৈতিক কাজে জড়িত।
পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বদানকারী নেতা কবি জসীম উদ্দীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান, কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদা পারভিন, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন রহমান, বর্তমান কমিটির উপসাংস্কৃতিক সম্পাদক বি এম লিপি আক্তার, তিলোত্তমা শিকদারসহ ৩০ জনের বেশি নেতার নামে এ রকম নানা অভিযোগ রয়েছে।
ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি ও হলে কক্ষ ভাড়া দেওয়ার কথা অস্বীকার করে শাহেদ খান বলেন, এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
শ্রাবণী শায়লা ও ফরিদা পারভিনের বিরুদ্ধে হলের পার্লার ও হলের সামনের দোকান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। একাধিক পত্রিকায় এ নিয়ে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। তবে ফরিদা পারভিন বলেন, পাঁচ-ছয় মাস আগে এ রকম একটি নিউজ হয়েছিল। তবে এর কোনো প্রমাণ নেই।
গত বছরের ২৩ জানুয়ারি নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকারী এক নারী শিক্ষার্থীকে শ্রাবণী শায়লা মারধর করছেন এবং পোশাক ধরে টানছেন- এমন ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
আল-আমিন রহমানের বিরুদ্ধে নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের সময় নারী নিপীড়ন, একটি বেসরকারি চ্যানেলের সংবাদকর্মীর ফোন ছিনিয়ে নেওয়া, বৈশাখী কনসার্টে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি নিপীড়নের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণই পায়নি। আর যাদের বিরুদ্ধে বৈশাখী কনসার্টে আগুন দেওয়ার অভিযোগ এসেছে, তাদেরই কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। অথচ জড়িত না থেকেও পদ পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
অভিযোগ, তিলোত্তমা শিকদারের পৃষ্ঠপোষকতায় আবাসিক কক্ষে নিয়মবহির্ভূতভাবে তার ছোট বোন অবস্থান করছেন। তার কক্ষে নিয়মবহির্ভূতভাবে টিভি, ফ্রিজ এবং আলমারিও ব্যবহূত হচ্ছে। তবে তিলোত্তমা বলেন, তারা পলিটিক্যাল রুমে থাকেন। কক্ষে গেস্ট পারমিশন বাবদ ১০০ টাকা করে দিয়ে পরীক্ষার্থী রাখার ব্যবস্থা আছে। দু-তিন দিন আগে পরীক্ষার সময় তার বোন এসেছিল বলে তিনি জানান, সে স্থায়ীভাবে থাকে না।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার শাহাজাদা বিবাহিত। ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক স্কুলছাত্রবিষয়ক সম্পাদক দেবাশীষ উপাচার্যের স্বাক্ষর নকলের দায়ে আজীবনের জন্য বহিস্কৃত হয়েছেন। তার নামে শাহবাগ থানায় একটি মামলাও রয়েছে। অভিযোগ, ডাকসুর বর্তমান সদস্য তানভীর হাসান সৈকত দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। সাবেক কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদক ইলিয়াস সানি, সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক রানা হামিদ, ঢাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি রুম্মান হোসেন, উপসম্পাদক আবুল হক রনি, ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সজীব, ইমদাদ হোসেন সোহাগ, শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হাসান সিফাত, কবি সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শারজিয়া শারমিন সম্পা, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফকির রাসেল আহমেদ, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের সভাপতি জিয়াসমিন শান্তা, সাধারণ সম্পাদক নিপু ইসলাম তন্বীসহ ৩০ জনের বেশি পদবঞ্চিত নেতার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে।
লিখিত দালিলিক প্রমাণের আহ্বান : ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে, তার লিখিত দালিলিক প্রমাণ আহ্বান করেছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান। এ সময় যারা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগ নিয়ে বিতর্ক ছড়াবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পদপ্রাপ্ত বিতর্কিতদের প্রসঙ্গে গোলাম রাব্বানী বলেন, তাদের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি, কিসের ভিত্তিতে তারা ব্যবস্থা নেবেন।