আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ৪৭ বছর আগে। কিন্তু এখনো অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো দেখলে মনে হয় আমরা যেন হয় ব্রিটিশ রাজত্বে বাস করছি, না হয় পাকিস্তান আমলে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিরা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-চাহিদা, তা বুঝত না। আন্দোলন, সহিংস আন্দোলন ছাড়া কিছুই তাদের কাছ থেকে অর্জন করা যেত না। আমার এই স্বাধীন দেশেও অনেক ক্ষেত্রে তা-ই দেখতে হচ্ছে। কদিন আগে গেল ঢাকা সিটির সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, অথচ কোনোই দরকার ছিল না এতদূর যাওয়া। সহজেই সমাধান করা যেত। আমরা করিনি ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করা পর্যন্ত। স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমাদের যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন বা দিচ্ছেন আমাদের দেশ সম্পর্কে, দেশের সমস্যাবলি সম্পর্কে, কৃষক-শ্রমিক-জনতা-শিক্ষার্থী কাদের কোথায় কী চাহিদা বা সমস্যা আছে সেগুলো তাঁদের অজানা নয়। সেদিকে তাঁরা না তাকিয়ে শুধুই যেন রাজনীতি রাজনীতি খেলা নিয়ে ব্যস্ত। আর সব কিছুকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ও সম্পৃক্ত করতে চান।
স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়ে আমরা ছোট ছিলাম। আমাদের পাশের বাড়ির বেশ সচ্ছল একটি পরিবার শহরে গিয়ে আশ্রয় নিল। দিব্যি দিন-মাস কাটাল। দেশ স্বাধীন হলো। তারা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিয়ে নিল। এখন মুক্তিযুক্ত ভাতা পাচ্ছে; যদিও গ্রামে ও শহরে রয়েছে তাদের বৈধ ও অবৈধ অনেক সম্পদ, দালানকোঠা বাড়িঘর। তাদের সন্তানরাও নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করছে। বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে যেখানে জালিয়াতি হয়, সেখানে এত বড় একটি বিষয় নিয়ে কজন সঠিক সার্টিফিকেট পাচ্ছে তার নিশ্চয়তা বা হিসাব কে রাখে? অথচ প্রায়ই পত্রিকার পাতায় ও ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের অনেক সন্তান কত কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে দেখেছি অনেক জানাশোনা, মেধাবী ও ভালো ফল করা তরুণ বিসিএসের কাছাকাছি গিয়ে আবার ফেরত এসেছে, চাকরি হয়নি। আমরা কদিন আগেও দেখলাম সচিব পর্যন্ত মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জোগাড় করে অত বড় পদে বসেছেন। একই দেশের নাগরিক হয়ে তাঁরা কী অপরাধ করলেন? বিষয়টি নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বহু আলোচনা করেছি।
আরেকটি বিষয়ও অবাক লাগে। বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত অঙ্গন। সেখানকার শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত চিন্তার অধিকারী। তারা যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে—এটিই স্বাভাবিক। এই প্রতিবাদ যাতে তারা না করতে পারে সে জন্য আইয়ুব খান তৈরি করেছিলেন এনএসএফ ছাত্র নামধারী গুণ্ডাবাহিনী। স্বাধীনতার পর তফাত কী হলো? সাধারণ ও মুক্তচিন্তার শিক্ষার্থীরা এরশাদ আমলে কথা বলতে পারত না, কথা বললেই ‘ছাত্রসমাজ’ নামের এনএসএফ যখন-তখন ঝাঁপিয়ে পড়ত শিক্ষার্থীদের ওপর। কারণে-অকারণে তাদের মাস্তানি ছিল ক্যাম্পাসময়। এরশাদ গেলেন। বিএনপি এলো। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজত্ব। একই কায়দায় সাধারণ ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করা ও চড়াও হওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। বিএনপি গেল। আওয়ামী লীগ এলো। ছাত্রলীগ এখন সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই ছাত্র সংগঠনের কাজ হবে আদর্শ শেখানো, অন্য কোনো ভূমিকায় তো তাদের দেখতে পাওয়াটা জাতি আশা করে না।
সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন কোটার প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। আন্দোলনকারীদের দাবি, ১০ শতাংশের বেশি কোটায় নিয়োগ দেওয়া যাবে না। গত ফেব্রুয়ারিতে টানা আন্দোলন চললেও গত ৮ এপ্রিলে তা ছিল সহিংস। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিপেটা করলেও আন্দোলনকারীরা ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং উপাচার্যের বাসভবনে আগুন দিয়েছে। এর সঙ্গে উপাচার্যের কী সম্পর্ক আছে? পুলিশের মারমুখী অবস্থান ও আচরণের কারণে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং পথচারীরা ছোটাছুটি শুরু করে প্রাণভয়ে। আর পুরো ঢাকায় যানজট তো তীব্র আকার ধারণ করেছিল।
তীব্র যানজটের শহর ঢাকা। কোনোভাবেই যেন যানজট নিরসন করা যাচ্ছে না। ঢাকার বাইরে কোথাও রওনা হলেন তো হঠাৎ দেখবেন কোনো কারণ ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ যানজট। শিশু-নারীদের এই যানজটে কী অবস্থা হয় বিবেকবান মানুষ একটু কল্পনা করে দেখুন। দেখবেন সেখানে কোনো পুলিশ নেই, সেখানে কোনো অ্যাকশন নেই। বরং পুলিশ নাকি আরো মজা পায়। কারণ তাদের চাঁদা তুলতে সুবিধা হয়। অথচ রাজনৈতিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো অনুষ্ঠানে পুলিশ যেন আন্দোলনকারীদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি থাকে। কী মজার দেশ! সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার কোনো সেবা পাবে না; কিন্তু কোনো বৈধ দাবি তুললে তা কিভাবে দমাতে হয়, তা তারা ভালোভাবেই জানে ও করে। অদ্ভুত সব আচরণ!
মেধার নির্বাসন দিয়ে দেশের প্রশাসনে ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য লোকদের বসালে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। সম্প্রতি সরকারি দলের এক নেতার সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের বৈঠক হয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকার ও রাষ্ট্র সঠিক পদক্ষেপ নেবে, আশা করি।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক