চুপসে গেছেন দাপুটে যুবনেতারা - দৈনিকশিক্ষা

চুপসে গেছেন দাপুটে যুবনেতারা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গোয়েন্দা ফাইল দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগ নেতাদের অপকর্মের বিষয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি এ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণের দুই নেতার বিষয়ে ইঙ্গিত করার পর সব মহলেই সরব আলোচনা শুরু হয়। শুদ্ধি অভিযান চালানো হতে পারে আশঙ্কায় নীরবে চলতে থাকেন দাপুটে সব যুবলীগ নেতা। বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) যুবলীগ  ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। রাজধানীর ফকিরাপুলে তাঁর নিয়ন্ত্রিত ক্লাব তথা ক্যাসিনো থেকে আটক করা হয়েছে অনেককে। কয়েক বছর আগে যুবলীগ নেতা মিল্কি ও তারেক হত্যার পর অগ্রভাগে উঠে আসা দক্ষিণের এই নেতাকে অস্ত্র উঁচিয়েও চলতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী যে দুজনের বিষয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খালেদ তাঁদের একজন। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন লায়েকুজ্জামান।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জানা গেছে, ১৪ সেপ্টেম্বর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বলেন, ‘কোনো চাঁদাবাজের দরকার নেই। বিপদ এলে আগে ওরা অস্ত্র নিয়ে পালাবে।’ আবেগতাড়িত হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বলেন, বঙ্গবন্ধুর লাশ বত্রিশ নম্বরে পড়ে থাকলেও কোনো আওয়ামী লীগ নেতা দেখতে যায়নি। আওয়ামী লীগকে আমি চিনি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কথা জানান সভায় অংশ নেয়া সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, ‘জঙ্গি দমনের মতোই দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য এবং তার পরই মাদকসংশ্লিষ্টতা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের প্রধান দুই নেতাকে অপসারণ ঘটনার পর আতঙ্ক ভর করে অপকর্মে জড়িত যুবলীগ নেতাদের মধ্যে। যুবলীগ দক্ষিণের নেতাদের অন্যতম মিলনস্থল কাকরাইলে নামে নীরবতা। আলোচিত এক নেতার অফিসের সামনে সড়কজুড়ে থাকা মোটরসাইকেলগুলোর আর দেখা মিলছে না। কিছুটা সতর্ক হয়ে গেছেন টাকা নিয়ে যুবলীগের পদ-পদবিতে বসিয়ে দেন এমন এক নেতাও।

এক যুবনেতার কাছে গতকাল জানতে চাওয়া হয়, রাজধানীর ইউনিট কমিটিগুলোর রেট কত চলছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি গরম, আপাতত চেপে আছি, পারলে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন।’ যুবলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘ওই সব রাজা-বাদশাহরা এক দিনে তৈরি হয়নি, তারা দলের দুর্দিনের কর্মী ছিল, সেই দুর্দিনের কর্মীদের যারা রাজা-বাদশাহ বানিয়ে কমিশন নিয়েছে, তাদের কথা কিন্তু কেউ বলছে না।’

সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংগঠনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদেরকে যুবলীগের ট্রাইব্যুনালে হাজির করে বক্তব্য নেয়া হবে।’

ঢাকাজুড়ে অনেক জুয়ার আসর বসে। অভিযোগ আছে, ওই সব জুয়ার আসর বা ক্যাসিনোগুলোর বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ নেতারা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার উত্তরা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত কম করে হলেও ১৫০ স্থানে জুয়ার নিয়মিত আসর বসানো হয়। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি স্পটে আছে পাশ্চাত্য কায়দায় জুয়ার ব্যবস্থা ক্যাসিনো। তবে সব জুয়ার আসর যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। যুবলীগের কয়েকজন নেতার নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাসিনোগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে আরামবাগ, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, পল্টন ও বনানী এলাকায়। এসব ক্যাসিনোর কয়েকটিতে বিদেশ থেকে আনা প্রশিক্ষত নারী-পুরুষ কাজ করেন। যুবলীগের তিন নেতা মূলত ক্লাবগুলোর জুয়ার আসরের নিয়ন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যে দুজনের বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়জন হচ্ছেন মতিঝিল-সবুজ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় রাজধানীতে সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত বারের সংখ্যা ৫৬টি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু উত্তরা থানাতেই বার আছে ৪২টি। যুবলীগ উত্তরের এক নেতা পরিচালনা করেন অনুমোদহীন একটি বার। উত্তরা-১ নম্বর সেক্টরের প্রধান সড়কের পাশে একটি ক্যাসিনো চালান সরকারের তালিকাভুক্ত বিদেশে পালিয়ে থাকা এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর ভাই।

ঢাকায় আধুনিক জুয়ার আসর শুরু হয় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মতিঝিল-সবুজ এলাকার এক যুবদল নেতার নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতার পালাবদলে যুবদল থেকে জুয়ার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে যুবলীগের হাতে। যুবলীগ নেতাদের হাতে জুয়া আরও সম্প্রসারিত ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। দেশি পরিচালনাকারীদের স্থলে এসেছেন বিদেশি নারী-পুরুষ।

শাহজাহানপুর-মতিঝিলের ভয়ংকর মানুষ হিসেবে পরিচিত খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া একাই নিয়ন্ত্রণ করেন আরামবাগ-ফকিরাপুল এলাকার ১০টি ক্লাব। ক্লাব মানেই জুয়া-ক্যাসিনো। প্রতি রাতে কম করে হলেও আয় ১০ লাখ টাকা। ফকিরাপুল ক্লাবপাড়ার পরিচিত এক মুখ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাবপাড়ায় আছি। বিভিন্ন সরকারের সময়ে বিভিন্ন রংঢঙের মাস্তানদের দেখেছি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে এখনকার মতো এত নানা কিসিমের জুয়া আগে ছিল না। এত টাকার খেলা আগে ছিল না। নেতার চামচারা রাতে ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে নেতার বাসায় পৌঁছে দেয়।’

উত্তরা-তুরাগ এলকার ৯টি ইউনিট যুবলীগের সম্মেলন ২২ সেপ্টেম্বর। উত্তরার একটি ইউনিট যুবলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী এক ব্যবসায়ী আলাপকালে বলেন, ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না, আমাদের নেতার মোহাম্মদপুরের বাসায় যেতে চাইলাম, নেতা নিষেধ করলেন। তাঁর গুলশানের বাসায় যেতে চাইলাম, নেতা ধমক দিয়ে বললেন, দেখা করার দরকার নেই। কমিশন নেয়া মধ্যস্থতাকারী নেতাও ফোনে বলে দিয়েছেন আপাতত বাসায় না আসতে।’ যুবলীগের পদপ্রত্যাশী ওই নেতা বলেন, ‘সম্মেলন তো চলে এলো, এখনো টাকা দিতে পারলাম না, মনে হয় আমার কাজ হবে না। সভাপতি আর হতে পারছি না।’

প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণের দুই নেতাকে ঈঙ্গিত করলেও উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব যুবলীগের একই দশা। শুধু যুব লীগের পদ বিক্রি করার মধ্যস্থতার কমিশন নিয়ে অগাধ বিত্তের মালিক হয়েছেন বেশ কয়েকজন। আপাতত এরা মধ্যস্থতার কাজে হাত দিচ্ছেন না, কেউ তদবির করতে গেলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে না করে দিচ্ছেন, তবে সরাসরি না করে অর্থের লোভ হাতছাড়াও করছেন না।

আগে-পিছে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের মহড়া, সড়ক বন্ধ করে মহড়া দিয়ে বাসায় ফেরা সেই নেতাও এখন একা চলছেন। মাস চারেক ধরে কাকরাইল এলাকার একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছেন কুমিল্লার সালামত আলী। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে আমাদের এলাকার এক নেতার বিশাল বিশাল মহড়া বন্ধ দেখছি, কারণটা বুঝছি না। নেতার কি পতন হয়ে গেল নাকি?’ খুব দুঃখের সঙ্গে সালামত আলী বলেন, ‘একদিন নেতা বের হওয়ার সময় তাঁর এক চামচার মোটরসাইকেলের সামনে পড়ে থাপ্পড় খেতে হয়েছিল।’

যুবলীগ দক্ষিণের এক নেতা সপ্তাহে এক রাতে রাজধানীর ছিন্নমূল কিছু মানুষকে নিজের পয়সায় খাওয়াতেন। ওই খাওয়ানো কর্মসূচি চালু থাকবে তো? এ নিয়ে ব্যথাতুর আলোচনা আছে ওই কর্মসূচির নিয়মিত অতিথিদের মধ্যে। অতিথিদের একজন, ছিন্নমূল আবদুর রহিমের জিজ্ঞাসা—‘শুনছি ভাই দেশে নেই, এখন আমাদের কে খাবার দেবে?’

যুবলীগ দক্ষিণের দাপুটে নেতাদের ঘনিষ্ঠ মাদারীপুরের এক যুবলীগকর্মী নেতাদের এক লোকের ১৩ লাখ পাওনা টাকা তুলে অর্ধেক নিজে নেয়ার চুক্তিতে ঢাকায় এসে এখন তাঁর মাথায় হাত, ভাইজানদের দেখা পাচ্ছেন না।

আদি বাড়ি নোয়াখালীতে, ছাত্ররাজনীতি করতেন ফরিদপুরের একটি উপজেলায়। এখন তিনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর। কাকরাইলকেন্দ্রিক ওই যুবনেতা এখন কম করে হলেও দুই হাজার কোটি টাকার মালিক। যুবলীগের পদ-পদবি, প্রভাব ব্যবহার করে হেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেন না। ওই নেতাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর জনপ্রতিনিধির কাজে বেশি সময় দিচ্ছেন, যুবলীগের দিকে কম আসা-যাওয়া করছেন। সেগুনবাগিচা এলাকার বাসিন্দা ফজলুল হক বলেন, ‘বহুদিন পর কাউন্সিলরকে এলাকায় দেখেছি, মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, আগে তো বাহিনী নিয়ে চলতেন।’

সংগঠন নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি, তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। যুবলীগ নেতাদের দুর্নীতির বিষয়, চাঁদাবাজির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেব।’

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040550231933594