দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হচ্ছে এস.ই.এস.ডি.পি (S.E.S.D.P) এর মূল লক্ষ্য। জোর দেয়া হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নের ওপর।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির চারটি ধাপ রয়েছে— জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। এরমধ্যে জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরাই সহজেই দিতে পারে। কিন্তু অন্য দুটি উত্তর দিতে পারে না। শিক্ষার্থীদের মূল বই হলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বই। সেই বই যদি দুর্বোধ্য, লেখায় ঘাটতি, চিত্রে ভুল বা সংখ্যার অঙ্কে ভুল হয় তখন শিক্ষার্থী চিন্তায় হাবুডুবু খায়। তখন ঐ বিষয়ের প্রতি তার অনীহা সৃষ্টি হয়। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা নির্ভর করে বিষয় শিক্ষকের ওপর। গত ২২ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত তথ্যানুসারে এখনো দেশে ৫২ ভাগ শিক্ষক নিজে স্কুলের পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। আবার বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি বলেন, “এখনো ৮০ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না, প্রশ্ন করতে পারেন না।” তার কারণ শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। নানাদিক থেকে তারা বঞ্চিত। তাহলে বিষয় শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আশা করতে পারে না। শিক্ষার্থী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করে। বাজারে কিছু প্রকাশনা সংস্থা আছে যারা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে দক্ষ লোকের মাধ্যমে গাইড বই তৈরি করে। এই গাইড বইগুলো বেশ গ্রহণযোগ্য হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়। বিনা পয়সায় গাইড বইগুলো পেয়ে শিক্ষকরাও উপকৃত হন।
শিক্ষকদের বঞ্চনা দূর করা জরুরি। শিক্ষকদের টেনশনমুক্ত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি নতুন কোনো পদ্ধতি নয়। এটি আগে চালু ছিল। কিন্তু শিক্ষকরা হয়ত না বুঝে এ পদ্ধতি ভয় পাচ্ছেন। তিনি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও স্কুল শিক্ষকদের ভীতি কমানোর ওপর জোর দেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকেই গ্রামে থাকেন। অভিভাবকও অনেকেই অসচ্ছল। পাঠ্যবইয়ের বাইরে নোট বই, গাইড বই বা সাজেশন বই কেনার সামর্থ্য অনেক অভিভাবকের নেই। কাজেই পাঠ্যবই এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বইটি হবে সহজে বোধগম্য, ভাষা হবে সহজ এবং আকর্ষণীয়। পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য পূরণে উদাহরণ থাকবে পর্যাপ্ত অর্থাত্ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। তাহলে শিক্ষার্থী বইটি পড়ে আনন্দ পাবে। ভীতি দূর হবে।
সকল পাঠকের মেধা সমান নয়। এটা লক্ষ রেখে পাঠ্য পুস্তক বোর্ড সহায়ক বই তৈরি করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে পারে। আর পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে একটি বিক্রয় কেন্দ্র থাকবে, যেখান থেকে ক্রেতারা সহজেই এই বইগুলো কিনতে পারবেন। পাঠ্য বইতে কোনো দুর্বোধ্য শব্দ/পদ থাকলে তার ব্যাখ্যা থাকবে সহায়ক বইয়ে। শিক্ষক বইটি পড়ে বুঝবেন এবং শিক্ষার্থীকে বোঝাবেন।
অবশ্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়ক্রমে, আবাসিক হওয়া উচিত। ফলে প্রশিক্ষণের পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ধারণা খোলাসা করার সুযোগ থাকে। যারা প্রশিক্ষক তাদের পুরো প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিতে আসতে হবে। কারণ কতিপয় মেধাবী আগ্রহী শিক্ষক অনেক প্রশ্ন করতে পারেন। তারা উত্তর দিতে অপারগ হলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায় বা প্রশিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব হয়।
গত ১৪ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ে ১৬ স্তরে দুর্নীতি’। প্রসঙ্গত দুর্নীতির কিছু বর্ণনা দিতে চাই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিজ্ঞপ্তি নং-৩৫, তারিখ:২৭-০২-১৯৯৫ খ্রিঃ বিজ্ঞপ্তির উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল নির্বাচিত পাণ্ডুলিপিসমূহ লেখক/ লেখিকা/ প্রকাশকগণ তাদের নিজ উদ্যোগে বোর্ডের অনুমতিক্রমে বাজারজাত করবেন এবং বোর্ডকে এজন্য রয়্যালটি দিতে হবে। ১২-১১-৯৫ তারিখের চিঠিতে আমি জানতে পারি আমার জমাকৃত ‘৯ম আবশ্যিক বীজগণিত’ পাণ্ডুলিপি নির্বাচিত হয়েছে। এরপর চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বরাবর নির্বাচিত পাণ্ডুলিপির বই বাজারজাত করার অনুমতি প্রার্থনা করি। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব টালবাহানা করেন এবং বুঝতে পারি শেষ পর্যন্ত আমি প্রতারিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। সেসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।
প্রতারণার আভাস যখন পাই তখন চেয়ারম্যান মহোদয়কে বলেছিলাম- “পান্ডুলিপি নির্বাচিত হওয়ার পর ঐ বিজ্ঞপ্তি নির্বাচিত লেখকদের সম্পত্তি; আপনি চেয়ারম্যান হলেও এর বাইরে কিছু করতে পারেন না?” আমি তার বিরাগভাজন হলাম। এই বইগুলোর উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হলেন নির্বাচিত পান্ডুলিপি লেখকরা এবং বিষয় বিশেষজ্ঞরা যার তালিকা বোর্ডে আছে। সেখানে আমার নাম নেই। এই ব্যাপারে তদন্ত হলে সব রাঘব-বোয়াল ধরা পড়বেন।
গত ৪-১০-২০১০ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদন করি। সভাপতি মহোদয় এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান মহোদয়কে বিষয়টি সুরাহা করে সংসদীয় কমিটিকে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু পরে এ ব্যাপারে কোনো উত্তর পাইনি। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কাছেও আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র জমা দেই। কোনো উত্তর পাইনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে সচেষ্ট হন এবং তদন্ত করেন আমাকে ডাকলে আমি যথাসম্ভব সাহায্য করবো।
লেখক :রচয়িতা, মাধ্যমিক বীজগণিত