যেসব বিষয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানকে নির্দেশ করে তার মধ্যে সমাবর্তন অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রতিটি শিক্ষার্থী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন সমাবর্তনের দিনটির জন্য। এই দিনে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারীরা সনদ গ্রহণ করে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সমাবর্তন হয়েছে মাত্র পাঁচবার। অথচ প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বাজেটে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর দ্বিতীয় সমাবর্তনটি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে, তৃতীয়টি ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে, চতুর্থটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে এবং সর্বশেষ সমাবর্তনটি অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পেরেছিলেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৪০ থেকে ৪৩তম আবর্তনের ৪টি ব্যাচের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী তাদের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করে ৬ষ্ঠ সমাবর্তনের অপেক্ষায় আছেন।
অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫১টি সমাবর্তন। ইতিমধ্যে ৫২তম সমাবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর তাদের ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। অথচ ৪৮ বছরে মাত্র ৫টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনায় হতাশা এবং দুঃখ প্রকাশ করেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ‘সমাবর্তন আয়োজন করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের প্রয়োজন। কিন্তু প্রায় সব সময়ই বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল থাকে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের আন্দোলন, ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি। তবে প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এসব পরিস্থিতিতেও নিয়মিত সমাবর্তন আয়োজন করা সম্ভব।’
এদিকে প্রশাসনের দাবি, সমাবর্তন আয়োজনের জন্য যত গ্রাজুয়েট প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর তত শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারছে না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হচ্ছে। দুই হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিবছর সমাবর্তন আয়োজন করা কষ্টকর।
এছাড়া সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে প্রতিবছরই বরাদ্দ রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘প্রতি অর্থ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বাজেটে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য দুই লাখ টাকা ধরে রাখা হয়। কিন্তু সমাবর্তন না হওয়ায় সে টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ মামুর বলেন, ‘সঠিক সময়ে সমাবর্তন না হওয়ার কারণে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণে অনীহা দেখা দিচ্ছে। ফলে অধিকাংশ বিভাগে যথাসময়ে ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন না শিক্ষকরা। এতে বাড়ছে সেশনজট। নিয়মিত সমাবর্তন হলে সবার মাঝে একটু হলেও দায়িত্ববোধ ফিরে আসবে।’
আইন ও বিচার বিভাগের ৪৩তম আবর্তনের ছাত্র খান মুনতাসির আরমান বলেন, ‘প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব আর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাই নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ার কারণ। তবে নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর এটি আয়োজন করার পরিকল্পনা প্রশাসনের থাকা উচিত। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর যখন এটি অনুষ্ঠিত হতে থাকবে তখন আর এটি বন্ধ হওয়ার কোনো পথ থাকবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সমাবর্তন আয়োজন করতে সময় লেগেছিল ২৬ বছর। এরপর থেকে অবশ্য প্রতি ৫-৬ বছর অন্তর অন্তর সমাবর্তন হচ্ছে। মূলত সমাবর্তন একটি ব্যয়বহুল আয়োজন।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘৪৯ বছরে মাত্র ৫টি সমাবর্তন হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বছরের শেষে একটি সমাবর্তন করার পরিকল্পনা আছে। এটা করতে পারলে নিয়মিত সমাবর্তনের একটা সংস্কৃতি চালু হবে বলে আশা করছি।’