জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) হলগুলো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। প্রতিটি হল ‘পরিচালনা’ করছেন ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতারা। হলগুলো পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন প্রশাসন থাকলেও ছাত্রলীগের প্রভাবে দায়িত্ব পালনে ‘ব্যর্থ’ হল প্রশাসন। প্রশাসনের তদারকি না থাকায় বেড়েছে ছাত্র নির্যাতন (র্যাগিং) ও মাদক সেবন। হলে অস্ত্র থাকার অভিযোগও রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাবিতে বর্তমানে ছয়টি ব্যাচে ১৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। আবাসিক হল রয়েছে ১৬টি। ছাত্রীদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ কম থাকলেও ছাত্রদের হলগুলোতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিরাজমান। হলগুলোতে নেই হল প্রশাসন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি। এতে ছেলেদের হলে বেড়েছে মাদক সেবন, র্যাগিং ও বহিরাগতদের আনাগোনা। শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানো, আসন বণ্টন, কক্ষের তালিকা, কোন শিক্ষার্থী কোন কক্ষে থাকবে, সাবেক শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া, বিচারিকসহ বিভিন্ন কাজ তারা করছে। কোনো কোনো হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা কোন পোশাক পরবে, ক্যান্টিনে কোথায় বসে খাবে তাও ঠিক করে দেয় ছাত্রলীগের কর্মীরা।
প্রশাসনিকভাবে সাধারণত প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীদের হলে সিট দেওয়া হয় না। ভর্তির সময় তাদের বিভিন্ন হলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। হল প্রাধ্যক্ষ প্রথম দিন এসে প্রথম বর্ষে ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের গণরুম নিশ্চিত করেন মাত্র। বাকিটা সময় তিনি শুধু দাপ্তরিক কাজকর্ম তদারকি করেন। পরে হলের শিক্ষার্থীদের সিট-সংক্রান্ত কিংবা তাদের সুবিধা-অসুবিধাসহ কোনো বিষয়েই খোঁজখবর নেন না প্রাধ্যক্ষ। এরপর শিক্ষার্থীদের হলে থাকা বা না থাকার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের হল কমিটি কিংবা জাবি শাখা কমিটির নেতারা।
শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর সময় আলাদাভাবে কোনো রেজিস্ট্রেশন কিংবা প্রশাসনিক কাজ করতে হয় না। ফলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ছাত্রলীগ নেতারা তাঁদের কর্মী বা অনুসারীদের হলে ওঠান এবং পরে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেন। সংগঠনটির কোনো নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে অপরাধমূলক কাজ করলে অধিকাংশ সময় তাদের কোনো ধরনের শাস্তির আওতায় আনতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ অবস্থায় প্রশাসনও তাদের কাছে ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছে।
জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে হল ছাত্রসংসদ নেই। তাই হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হলের কক্ষ বরাদ্দসহ বিভিন্ন কাজ করছে ছাত্রলীগ। এটি নিয়ন্ত্রণ নয়, সহযোগিতা মাত্র। আমরা এসব কাজ করতে চাই না, সাংগঠনিক কাজগুলোতে মনোনিবেশ করতে চাই। শিক্ষার্থী নিয়মানুযায়ী লেখাপড়া শেষ করার সাত দিনের মধ্যে কক্ষ খালি করে দিলে আমাদের এসব দেখার প্রয়োজন ছিল না।’ তিনি দাবি করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন হলগুলোতে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। প্রশাসন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এবং তাদের অবহেলা রয়েছে বলেই আমরা বড় সংগঠন হিসেবে সহযোগিতা করছি। হল প্রশাসন যদি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে আমাদের আপত্তি নেই।’
হলে মাদক ও অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র নেই। হলগুলোতে ছাত্রলীগের কর্মীদের বাইরেও অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ মাদক সেবন করলে কিংবা অস্ত্র রাখলে তার দায়ভার প্রশাসনের, ছাত্রলীগের না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এটা নিয়ন্ত্রণ নয়, একটা টিমওয়ার্ক। ছাত্রলীগ হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করছে, যা হল ছাত্রসংসদের করার কথা। আমাদের হল ছাত্রসংসদ নেই, তাই ছাত্রলীগ বড় সংগঠন হিসেবে আমাদের সহায়তা করছে। প্রশাসনিকভাবে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে।’ হলগুলোতে মাদক সেবন ও অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সকলকে সজাগ থাকতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সেগুলো উদ্ধার সম্ভব। অতীতে হল রেইড দিয়ে কাজ হয়নি। তাই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করতে পারে। মাদকের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং ও সচেতন করতে হবে। যেসব এলাকা থেকে মাদক সরবরাহ হয় সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। তাহলেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’