মাত্র দশ মাস পড়াশোনা করে ১৩ বিষয়ের ১ হাজার নম্বরের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা একজন ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার ছিল। গত বছর থেকে তিনটি বিষয় স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন করার প্রথা চালু করে জেএসসি পরীক্ষার জন্য ৮৫০ নম্বর নির্ধারিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ঘাড় থেকে বড় একটি বোঝা নেমে গেছে। এ সিদ্ধান্ত নি:সন্দেহে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সকল মহলের প্রশংসা অর্জন করেছে৷ তবে স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন রয়েছে৷ তিন বিষয় জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার কারণে স্কুলের ক্লাশ রুটিন থেকে এ তিনটি বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে৷ যা-ই হোক, শিক্ষকদের ওপর অর্পিত এ দায়িত্ব পালনে তারা ফাঁকি দিলে কিংবা দায়িত্ব পালনে বিবেকের তাড়া অনুভব না করলে কেউ জোর করে যথাযথভাবে পালন করাতে পারবেন না৷
চলতি বছর আরো একটি বিষয়, কৃষিবিজ্ঞান, বাদ দিয়ে এবং বাংলা এবং ইংরেজি বিষয় থেকে ৫০ করে বাদ দিয়ে মোট ৬৫০ নম্বরের জেএসসি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা মোটামুটি বাস্তবায়নের পথে৷ কিন্তু গত বছরের তিনটি বিষয় এবং এ বছরের তিনটি বিষয়ের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা৷ আকাশ পাতাল তফাৎ না বললেও বলব, এর থেকে কোনো অংশে কম নয়৷
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ৷ কৃষিবিষয় স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নের অন্তর্ভুক্ত না করলে মূল্যায়ন যথার্থ হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ বিগত কয়েক বছরের স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এতে অনেক প্রশ্ন ও গুঞ্জন ছিল৷ প্রথম ছিল এসবিএ৷ শতকরা কয়টি স্কুল সেটি পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করেছিল তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। অবশেষে তা বাদ দেয়া হয়েছে এবং এর পরিবর্তে ৩০ নম্বর থেকে কমিয়ে ২০ নম্বরের সিএ করা হয়েছে৷ কিন্তু সেটি ক'টি স্কুলে পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করছে, তা সময়ই বলে দেবে৷ গত বছরের জেএসসির একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টের দিকে লক্ষ্ করলে দেখা যায়, স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নের বিষয়গুলোতে প্রায় সবাই এ+ পেয়েছিল। চার বিষয়ের অধিক ফেল করেও সেই তিনটি বিষয়ে এ+ দেখা যায়। এক অভিভাবককে গর্ব করে বলতে শোনা গেছে, তার ছেলে তিন বিষয়ে এ+ পেয়ে ফেল করেছে। এতে বিষয় শিক্ষকের দোষ দেয়াও ঠিক হবে না৷ কারণ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর ক্ষমতা শিক্ষকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি৷ এমনও এলাকা আছে যেখানে শিক্ষক পূর্ণ নম্বর না দিলে তিনি আর স্কুলে আসতে পারতেন না।
এ বছর স্কুলগুলোতে পূর্বের বছরগুলোর মতো সে বিষয়গুলো এত গুরুত্ব দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা হয়েছে কিনা? কিন্তু কৃষি বিষয় ও পূর্বের বিষগুলোর গুরুত্ব কি সমান বলা যাবে? অভিজ্ঞতার আলোকে যদি কৃষি ও এসবিএও গত বছরের স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নের বিষয়সমূহের মত হয়, তাহলে কৃষি সম্পর্কে ছাত্রদের দুর্বলতা নম্বর ফর্দে থেকে বোঝা না গেলেও শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে বোঝা যাবে৷ আর ইংরেজি বিষয়ের নম্বর কমালে ইংরেজি শেখার অবস্থা কী হবে? বিগত কয়েক বছরের ফলাফল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ইংরেজি ও গণিতে ফেলের হার বেশি এবং এ দুই বিষয়ের ফলাফল পুরো পরীক্ষার ফলাফলের ওপর প্রভাব খাটায়৷ প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ইংরেজি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বছরে ২-৩টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও বারো বছরের পড়াশোনা শেষ করে শতকরা দশ জন শিক্ষার্থী শুদ্ধ দশ লাইন ইংরেজি লিখা কিংবা ইংরেজিতে দশটি বাক্য বলতে পারে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। শুধু তাই নয়, উচ্চ শিক্ষিত কিছু লোকের দিকে তাকালেও আমাদের দেশে ইংরেজি শিখার অবস্থাটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে৷
২০১০ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষানীতির আলোকে ষষ্ঠ-৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি থেকে ৫০ নম্বর করে কমিয়ে ফেলা হয়েছে৷ সম্প্রতি জেএসসিতে আরো ৫০ নম্বর কমানে সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে? ইংরেজিতে কি আমাদের ছাত্ররা আগের চেয়ে বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে নাকি বেশি দক্ষ হওয়ার কারনে নম্বর ও ডিউরেশন কমানো হয়েছে?
বাংলাদেশে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এখানকার চাকরির বাজার অনেকাংশে বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে৷ এর কারণ হিসেবে এ দেশের শ্রমিকেরা ইংরেজিতে দুর্বল বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে৷ [সূত্র : দৈনিক শিক্ষা ২১/০৫/২০১৮]৷ জেএসসি পরীক্ষায় ইংরেজিতে আরো ৫০ নম্বর কমিয়ে পূর্বের ২০০ নম্বরের মধ্যে ১০০ নম্বরই কমিয়ে আর মাত্র ১০০ নম্বর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিধান রাখলে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা আরো দূর্বল হবে নয় কি?
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী গত ২২ মে একনেক সভায় বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ে বাড়তি জোড় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন [সূত্র : দৈনিকশিক্ষা ২৩/০৫/২০১৮]৷ তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ইংরেজি বিষয়ের নম্বর না কমিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে পূর্বের অবস্থানে নেয়া উচিত৷
কোনো বিষয়ের নম্বর কমানো হলে সে বিষয়ের কিছু লেসন কমিয়ে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করা উপযোগী করে মান বণ্টন করা হয়৷ ইংরেজি দুই পত্রে ২০০ নম্বরের সময় রিডিং টেস্ট, রাইটিং টেস্ট ও গ্রামারে যে আইটেমগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল, ৫০ নম্বর কমানের পরে তা থেকে কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে৷ এখন আরো ৫০ নম্বর কমানে হলে আরো আইটেম বাদ দেয়া হতে পারে৷ আর যে লেসনগুলো বাদ দেয়া হয় কিংবা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকে না, সেগুলো শিক্ষার্থীরা কখনো পড়তে চায় না৷ তাছাড়াও বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি সিলেবাসের কোনো ধারাবাহিকতা নেই বললেও চলে৷ বলা যায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে যে গ্রামার পড়ানো হয় ১০ম শ্রেণিতে প্রায় সে গ্রামারই পড়ানো হয়৷ এতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের চেয়ে মনোযোগহীন কিংবা জোরপূর্বকই শিখে৷
সাধারণত মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে ইংরেজি ভিত্তি মজবুত করার সময়৷ আর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মৌসুমও বলা যায়৷ কারণ ৯ম শ্রেণিতে উঠতেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়গুলোর দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে৷ তখন ইংরেজি বিষয়ের প্রতি আগের মতো এত গুরুত্ব দেয়ার সময় পায় না৷ এ জন্য ৮ম শ্রেণি পর্যন্তই শিক্ষকেরা ও শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজির প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে পারেন৷
পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখ লোক বহির্বিশ্বে কর্মরত৷ তাদের একটি বিরাট অংশই কোনো রকম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ গিয়েছেন৷ এ শ্রেণির লোকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই৷ তারা যদি ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি ভালোভাবে শিখে যেতে পারে, তাহলে বিশ্বের যেকোনো দেশের লোকদের সাথেই কাজ কর্মের কথা বলার জন্য অন্তত প্রাথমিকভাবে ভাষাগত কোনো সমস্যা হবে না৷ তাই বাংলাদেশে ইংরেজি শেখার গুরুত্ব বিবেচনা করে জেএসসিতে ইংরেজি বিষয়ে আর নম্বর না কমানোর পুনরায় বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি৷
লেখক: সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি, বড় গোবিন্দপুর এবিএম হাইস্কুল, চান্দিনা, কুমিল্লা
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]