ঢাবি কেন কুখ্যাত আইয়ুব খানের ডিগ্রি বাতিল করে না? - দৈনিকশিক্ষা

ঢাবি কেন কুখ্যাত আইয়ুব খানের ডিগ্রি বাতিল করে না?

সাখাওয়াৎ আনসারী |

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে এ বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজন করতে যাচ্ছে এক বিশেষ সমাবর্তনের এবং সেখানেই তাঁকে অর্পণ করা হবে 'ডক্টর অব লজ' ডিগ্রি। আমরা এই ডিগ্রি প্রদানকে শতভাগ সমর্থন জানাই এবং এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জানাই অকুণ্ঠ অভিনন্দন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই ডিগ্রি প্রদানকে কেন্দ্র করে আমাদের রয়েছে সামান্য কিছু বক্তব্য। এবার তারই অবতারণা।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রায় শতবর্ষে ৫২টি সমাবর্তনের মাধ্যমে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে মোট ৫২ জনকে। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তালিকাটি বিচার-বিশ্নেষণ করে দেখেছি, এঁদের মধ্যে ৪৯ জন অতি সম্মানিত; তাঁদেরকে ডিগ্রি প্রদান শতভাগ সমর্থনযোগ্য। কিন্তু বাকি তিনজনকে যে ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। বিশেষত ইস্কান্দার মির্জা (১৮৯৯-১৯৬৯) এবং মোহাম্মদ আইয়ুব খান (১৯০৭-১৯৭৪)। এ দু'জনকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, তাঁদের অনুকূল সময় ও পরিস্থিতিতে মির্জা ইস্কান্দারকে ১৯৫৬ সালে এবং আইয়ুব খানকে ১৯৬০ সালে আয়োজিত দুটি সমাবর্তনে। ডিগ্রিপ্রাপ্তিতে এ দু'জনের আগ্রহ যেমন ছিল, ধারণা করা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের স্তুতিরও নিতান্ত ঘাটতি ছিল না।

ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন পাকিস্তানের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট, যদিও দুটি পদেই তিনি ছিলেন অবৈধ। নিয়মিত গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সুস্থ হয়ে ফিরে গোলাম মোহাম্মদের দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগ মুহূর্তে ইস্কান্দার তাঁকে স্বপদে যোগদান করতে না দিয়ে নিজেই পদটি দখল করেছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নির্বাচনই না করে তিনি প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পৌনে ৯ বছর পর বহু প্রতীক্ষিত সংবিধান প্রবর্তিত হলেও মাত্র আড়াই বছরের মাথায় তিনি সংবিধানটি বাতিল করে দেন। সংবিধান বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সামরিক আইন জারি করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেন, দুই সরকারকেই বরখাস্ত করেন, সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার-জেল-জুলুম শুরু করেন। এর আগে ৫৫ সালের ১ জুন থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি পূর্ববাংলার গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। ১ জুন তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে পা রেখেই সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মওলানা ভাসানীকে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এতটাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন যে, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই তিনি বঙ্গবন্ধুসহ শ'পাঁচেক রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করেছিলেন। ৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারির মাত্র ৪ দিনের মাথায় আবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অবৈধ গভর্নর জেনারেল ও অবৈধ রাষ্ট্রপতি, ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী, সংবিধান ও গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং সামরিক আইনের সূচনাকারীকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে তাকে গৌরবান্বিত করেছে।

প্রচণ্ড ক্ষমতালিপ্সু, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দাম্ভিক আইয়ুব খান নামে-বেনামে সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় সাড়ে ১০ বছর। অবৈধ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার কর্তৃক জারিকৃত সামরিক আইনের মাত্র ২০ দিনের মাথায় পিস্তলের মুখে ইস্কান্দারকে সরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরেক অন্যায়ের মাধ্যমে আইয়ুব সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। সারাবিশ্বে এটিও নজিরবিহীন যে, তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ই। আইয়ুবের ঘৃণ্য কর্মের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তার মধ্যে কয়েকটি হলো :মৌলিক গণতন্ত্র নামে অদ্ভুত পদ্ধতি প্রবর্তন, বিডি মেম্বারদের মাধ্যমে প্রহসনমূলক প্রেসিডেন্ট হওয়া, দলবিহীন পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগকে ক্ষমতায় আনা, উদ্ভট 'আইয়ুবের সংবিধান' প্রবর্তন, 'এনএসএফ' নামে পেটোয়া বাহিনী তৈরি, কুখ্যাত মোনায়েম খান ও ড. ওসমান গণিকে যথাক্রমে পূর্ববাংলার গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ, ছাত্রদের কাছে অগ্রহণযোগ্য শরিফ শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং পরাজিত হয়েও নির্লজ্জভাবে 'ফিল্ড মার্শাল' উপাধি গ্রহণ, ব্যাপক বৈষম্যের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা। আইয়ুবের শাসনামলে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বেশি জুলুমের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু। '৬২ থেকে '৬৬ পর্যন্ত তাঁকে মোট ১০ বার গ্রেপ্তার করা হয়। '৬৬ সালের প্রথম ৩ মাসেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় মোট ৮ বার। এই জঘন্য আইয়ুবকেই ডিগ্রি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানকে ডিগ্রি প্রদান কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে ডিগ্রি দিয়ে তাঁর নাম এই দুই কুখ্যাতের সঙ্গে একই তালিকায় রাখা কতটুকু শোভন। বঙ্গবন্ধুর বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিতে পারলে এই তিনের ডিগ্রি কেন প্রত্যাহার করা হবে না? আইয়ুব গেটকে আসাদ গেট, পাকমটরকে বাংলামটর, জিন্নাহ অ্যাভিনিউকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, জিন্নাহ হলকে সূর্য সেন হল করা গেলে এ দু'জনের নাম কেন মুছে ফেলা যাবে না? বঙ্গবন্ধুকে ডিগ্রি দিন, তবে বুঝতে হবে- জঞ্জাল ও আগাছা সাফ করে বৃক্ষরোপণই বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক: সাখাওয়াৎ আনসারী, অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সূত্র: দৈনিক সমকাল। 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069100856781006