দর্শনভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার - দৈনিকশিক্ষা

দর্শনভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্লেটো বলতেন, ‘বিস্মিত হওয়াটা মূলত দার্শনিকের অনুভূতি এবং দর্শনের জন্ম বিস্ময় থেকেই।’ এরিস্টেটলও বিষয়টি এমনভাবেই ভাবতেন। প্লেটোর এই বিস্ময় কেবল তীব্র আকর্ষণ বা সম্মোহন শক্তি নয়। বরং ঘুমন্ত সত্তাকে জাগ্রত করে নিজেকে নতুনভাবে জানার ও বোঝার রহস্যময় শক্তি। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের একটি ঘটনা এধরনের দর্শনগত ধারণার দৃষ্টান্ত হতে পারে। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, একবার এক লোক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ধনী আর কেউ আছে কি?’ বিল গেটস জবাব দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, এমন একজন আছেন যিনি আমার চেয়েও ধনী।’ তারপর তিনি একটি গল্প বললেন। ‘এই সময়টি ছিল যখন আমি ধনাঢ্য বা বিখ্যাত ছিলাম না।’ ‘একবার নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে একজন সংবাদপত্র বিক্রেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হলো।’ ‘আমি একটি সংবাদপত্র কিনতে চেয়েছিলাম; কিন্তু দেখেছি আমার কাছে যথেষ্ট টাকা নেই। তাই আমি কেনার সিদ্ধান্ত ছেড়ে পেপারটি বিক্রেতার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।’ ‘আমি তাকে আমার অবস্থার কথা বলেছি।’ বিক্রেতা বললেন, ‘আমি আপনাকে বিনামূল্যে দিচ্ছি।’ আমি পত্রিকাটি নিয়েছিলাম। ‘দুই থেকে তিন মাস পরে আমি একই বিমানবন্দরে আবার অবতরণ করেছি এবং কাকতালীয়ভাবে আবারও সেই পত্রিকা বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হলো। বিক্রেতা আমাকে আজও একটি পত্রিকা অফার করলেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আমি এটি নিতে পারি না কারণ এখনো আমার পরিবর্তন আসেনি। তিনি বললেন, ‘আপনি এটি নিতে পারেন, আমি এটি আমার লাভাংশ থেকে আপনাকে দিচ্ছি, আমার ক্ষতি হবে না’। বিক্রেতার আগ্রহে আমি পত্রিকাটি নিয়েছিলাম। ‘ঐ ঘটনার ১৯ বছর পরে আমি বিখ্যাত এবং মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠি। হঠাৎ একদিন মনে পড়ে গেল সেই পত্রিকা বিক্রেতার কথা। আমি তাকে খুঁজতে শুরু করে দিলাম এবং প্রায় দেড় মাস অনুসন্ধানের পরে আমি তাকে খুঁজে পেলাম। ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি বিল গেটস।’ আমি তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার কি মনে আছে একবার আমাকে বিনামূল্যে একটি পত্রিকা দিয়েছিলেন?’ বিক্রেতা বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে আছে। আপনাকে দুই বার দিয়েছি।’ ‘আমি বললাম, ‘আপনি যে আমাকে বিনামূল্যে পত্রিকা দিয়েছিলেন তা আমি ফিরিয়ে দিতে চাই। আপনি আপনার নিজের জন্য যা চান বলুন? আমি এটি পূরণ করব।’ বিক্রেতা বললেন, ‘স্যার, আপনি এমন কিছু দিতে পারবেন না, যা আমার সাহায্যের সমান হবে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে সংবাদপত্র দিয়েছিলাম আমার দরিদ্র অবস্থান থেকে। আর আপনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়ে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। আপনার সাহায্য কীভাবে আমার সাহায্যের সমান হবে?’ ‘সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সংবাদপত্রের বিক্রেতা আমার চেয়ে বেশি ধনী, কারণ তিনি কাউকে সাহায্য করার জন্য ধনী হওয়ার অপেক্ষা করেননি।’

এখান থেকে যে দর্শনগত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তা হলো, অর্থ থাকলেই মানুষ ধনী হতে পারে না। বরং যে মানুষের মধ্যে উদার চিন্তাবোধ ও একটি ইতিবাচক মন থাকে তিনিই প্রকৃত ধনী। এ প্রসঙ্গে আধুনিক যুগের দার্শনিক লুদভিগ ভিটগেনস্টেইন মনে করেন, যা বোঝা খুব দুঃসাধ্য ও কঠিন তাকে সরল মনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে অনুভব করা হলো দর্শনের মূলশক্তি। বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের ধারণটি একটু অভিনব ও ভিন্ন। দর্শনের শুরু খুব সাদামাটা কিছু থেকে, যা আসলে সে না। আর শেষটা এমন প্যারাডক্স দিয়ে, যা কেউ বিশ্বাস করবে না। অন্যদিকে সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘আমি শুধু একটা জিনিসই জানি। সেটা হচ্ছে আমি কিছুই জানি না।’ কথাটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও সহজ নয় বরং গভীর রহস্যপূর্ণ। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন—তিনি একটি জিনিস জানেন। আবার কারো ধারণা হতে পারে—তিনি কিছুই জানেন না। নাকি অনেক বিষয় জানেন? প্যারাডক্স হচ্ছে সে ধরনের বাক্য বা উক্তি, যেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। বরং এ ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটলে পরস্পরবিরোধী সমাধান তৈরি করে, যার একটিকে সত্য বলে মেনে নিলেও অন্যটিকে মানা যায় না। কিছু প্যারাডক্স আছে যাদের কোনো সমাধান নেই, আবার কিছু আছে যাদের ক্রিটিকাল ও লজিকাল সমাধান আছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ‘মিথ্যাবাদী’ প্যারাডক্সকে বিবেচনায় আনতে পারি। যেমন অনেক কথা বলার পর একজন বলে বসল—আমি মিথ্যা কথা বলছি, এখন তার আগের বলা কথাগুলো এই একটি বাক্যের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। যদি তার বাক্যটি সত্য মেনে নেওয়া হয়, তবে সে মিথ্যা কথা বলেছে যদিও এই বাক্যে বলার আগে তার কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়েছিল। অন্যদিকে যদি তার বাক্যটিকে মিথ্যা বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে নিজেকে সে যে মিথ্যাবাদী বলছে সেটি মিথ্যা অর্থাত্ সে তার কথাগুলো সত্য ছিল যদিও ধরে নেওয়া হয়েছিল সে যে কথাগুলো বলেছিল তা মিথ্যা ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই সমাধানগুলো পরস্পরবিরোধী। হতে পারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি পরস্পরবিরোধী; কিন্তু এ ধরনের ঘটনাগুলো আমাদের মধ্যে বহুমাত্রিক ভাবনা সৃষ্টি করছে যেখানে আবেগের চেয়ে যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মানুষের আবেগ থাকা ভালো; কিন্তু সে আবেগ যেন যুক্তির বাইরে না হয়। যদি কোনো কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মানুষ আবেগকে প্রাধান্য দেয় তবে সেখান থেকে নীতিহীনতা ও অনৈতিকতার জন্ম হতে পারে। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে প্রতিটি মানুষকে তার সিদ্ধান্তের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে হবে। সিদ্ধান্তের নেতিবাচক ও ইতিবাচক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মানুষকে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসেচুসেটসের গবেষকরা বলছেন—সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হলো, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি বেছে নেওয়া বা সঠিক আইডিয়াটি বের করা। এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো—সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অনেকগুলো বিকল্প থাকতে পারে। তবে বিকল্প সিদ্ধান্তগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। এর কারণ হচ্ছে—১৯৮২ সালে মনোবিদ ড্যানিয়েল কেইনিম্যান, পল স্লোভিচ এবং আমোস টিভেরস্কিত তাদের ‘Judgment Under Uncertainty’ বইয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানসিক বাধা বা ‘psychological bias’-এর ব্যাখ্যায় তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে— মানুষের মধ্যে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তিহীনতা ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব কাজ করে তখন মানুষ হয়তো সব তথ্যের দিকে না তাকিয়ে যেসব তথ্য তার ধারণাকে সমর্থন করে, কেবল সেগুলোকে গ্রহণ করে। এর ফলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। যার নেতিবাচক ফলাফল ব্যক্তি ছাড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর পড়ে। মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষকে দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে বিবেচনায় আনতে হবে। এর সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিজের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টিকেও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের প্রকৃত অধিকার ও ন্যায্যতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056250095367432