দেশে হচ্ছেটা কী? শিশুরা কি রেসের ঘোড়া? - দৈনিকশিক্ষা

দেশে হচ্ছেটা কী? শিশুরা কি রেসের ঘোড়া?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষাবিদ ও পাবলিক পরীক্ষার কাজে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলছেন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর আরও চাপ এবং কোচিং ও প্রাইভেটের ওপর নির্ভরতাও বাড়বে। আবার কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন, ওপরের দিকে নম্বরের স্তর একাধিক হওয়াই ভালো। যারা খুব ভালো শিক্ষার্থী, তারাই সেটা অর্জন করবে। বুধবার (৪ মার্চ) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত মতামতে তথ্য জানা যায়। 

মতামতে আরও জানা যায়, খবরটা পড়ে আমি শিউরে উঠেছি। বুকটা ধকধকিয়ে কাঁপছে। খবরে বলা হচ্ছে, ‘পাবলিক পরীক্ষায় ফলের সর্বোচ্চ সূচক ‘এ’ প্লাস পেতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে ৯০ থেকে ১০০-এর মধ্যে নম্বর পেতে হবে। এর মাধ্যমে ‘এ’ প্লাস পাওয়া বা সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ) অর্জন করা কঠিন হবে বলে শিক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন। ...চলতি বছরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা থেকেই পাবলিক পরীক্ষার ফল নতুন গ্রেডে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরপর আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা থেকেও নতুন গ্রেডে ফল প্রকাশ করা হবে। এতে ফলের সর্বোচ্চ সূচক হবে জিপিএ-৪, যা বর্তমানে জিপিএ-৫। নতুন গ্রেডে নম্বরের শ্রেণিব্যাপ্তি হবে আটটি, বর্তমানে আছে সাতটি।

জিপিএ–৫-এর স্কেল কমিয়ে করা হচ্ছে চার। আর এ প্লাস হবে ৮০<৯০ নম্বরে। মাঝে বসে যাবে নতুন দুই মাইনাস। এ বছরই জেএসসি থেকে চালু হবে। প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষায় এ সিদ্ধান্ত।

দেশে হচ্ছেটা কী? যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরীক্ষার আসমান সমান চাপ, সবই সইতে হবে শিশু আর কিশোরদের? শিশুদের সব আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে একটি অসৎ গোষ্ঠী। বইয়ের বোঝা, বিশাল সিলেবাস তো আছেই। সবার মাথায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে পরীক্ষা নামের দৈত্য।

কর্তাদের নিত্যনতুন আবিষ্কারে লাখো শিশু অস্বাভাবিক মানসিক পীড়নে। সে পীড়নে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ে পরীক্ষার ফল বের হলেই। জিপিএ-৫ যেন হ্যামিলনের বাঁশি। একবার সে সুর কানে গেলে রক্ষা নেই। যেমন বংশীবাদকের সুরে পাগল হয়ে মধ্যযুগে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হ্যামিলন শহরের শিশুরা ইঁদুরের মতো সার বেঁধে ছুটে গিয়ে নদীতে ডুবে মরেছিল উন্মাতাল শিশুরা। সে কাহিনি সবার জানা। তাই বিশদ না করি।

ইঁদুরদৌড় বন্ধ করতেই নাকি বিভাগ পদ্ধতি থেকে গ্রেড পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রথমে ছয় পরে সাত গ্রেড হলো। সাত গ্রেডেই নাভিশ্বাস ওঠে ছাত্রছাত্রীদের। দৌড় শুরু কোচিং সেন্টারে সেন্টারে। গরিব মানুষ হ্যাতাখ্যাতা বেচে ছেলেমেয়েকে পাঠায় সেখানে। পড়ুয়া থেকে অধঃপতিত করা হয় পরীক্ষার্থীতে। তার মূল্য দিচ্ছে সমগ্র জাতি। এ বিষয়ে লিখেছিলাম ‘পরীক্ষা পদ্ধতি: নেই কাজ তো খই ভাজ’।

বিনোদনের সময়হীন দিনরাত্রি নোট-গাইডে মত্ত শিশুর সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার সব দরজা বন্ধ। এদের অনেকেই একটা সময় মানসিক সমস্যায় পড়ে ক্লিনিকে ক্লিনিকে ধরনা দিয়ে জীবনের স্বপ্নময় দিনগুলো নষ্ট করছে। এখন সেখানে নতুন চাপ বাড়বে। এমন মানসিক বিপর্যয়ের শিকার প্রজন্ম কী করে চতুর্থ বিপ্লবের কান্ডারি হবে?

শিশুরা নাহয় মোহনবাঁশিতে ভোলে। কিন্তু রাজপাটে আসীন যারা, আর যারা অভিভাবক, তারাও এমন উন্মাদ হলো কেন? এ কি তবে গণহিস্টিরিয়া? সে হিস্টিরিয়ায় অবোধ, নিষ্পাপ শিশুরা কেন হবে রেসের ঘোড়া? সন্তানের ওপর বাজি ধরছে মা-বাবা, বাজি ধরছে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। সে রেসে পাগলের মতো দৌড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে শিশুদের। ডোপিং চলছে কোচিংয়ে পাঠিয়ে।

ফল হচ্ছে ভয়ংকর। এ দেশে এখন শিশু নির্যাতন বেড়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক, রাষ্ট্র মিলে গড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর নির্যাতক সিন্ডিকেট। আপনজনের কাছে সে নিরাপদ নয়, না বাবার কাছে, না শিক্ষক কিংবা রাষ্ট্রের কাছে। এরা কেউ তার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবে না। শুধু নিষ্ঠুর আচরণে শৈশবকে কলুষিত করছে। বাড়াচ্ছে বইয়ের বোঝা, সিলেবাসের বোঝা, পরীক্ষার বোঝা।

পাঠ্যপুস্তকে দাঁত বসাতে পারছেন না শিক্ষিত মা–বাবা, এমনকি শিক্ষকেরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডা গন্ডা পণ্ডিতের লেখা বই না সুখপাঠ্য, না সহজবোধ্য। শিক্ষকেরা তা ক্লাসে পড়াতে পারেন না, পরীক্ষার প্রশ্ন করতে পারেন না, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পারেন না। সব জরিপ বলছে, শিশুরা সার্টিফিকেট পাচ্ছে, কিন্তু পারছে না শিখতে।

বইয়ের চাপ, সিলেবাসের চাপ, পরীক্ষার চাপ, সৃজনশীল শিক্ষার চাপে, জিপিএর চাপে পিষ্ট শিশু। কিন্তু সন্তুষ্টি নেই কারও। কেউ ফেল করে কাঁদছে, কেউ কাঙ্ক্ষিত জিপিএ না পেয়ে কাঁদছে। কারও যদি জিপিএ ভালো তো জিপিএ গোল্ডেন নয়, তাই কাঁদছে। তার সঙ্গে উটকো যোগ হয়েছে নম্বরের চাপ। গোল্ডেন পেলেও কম নম্বরে জিপিএ পেয়েছে, তাই কাঁদছে। একটু ভুল হলো, তাদের কাঁদাচ্ছে মা–বাবা, কাঁদাচ্ছে শিক্ষক, স্কুল এবং স্বয়ং রাষ্ট্র। কাউকে পেটাচ্ছে বেদম। কাউকে বা বকছে। ভুলে যাচ্ছে, শিশুরও আত্মসম্মান আছে। কোমল সম্মানে আঘাত এলে তা অসহ্য হয়ে ওঠে। সর্বক্ষণ নিপীড়নের শিকার হয়ে যাচ্ছে মানসিক প্রতিবন্ধী। সে হাসতে ভুলে যাচ্ছে, খেলতে ভুলে যাচ্ছে, খেতে তার অরুচি হচ্ছে, কথা বলতে চাচ্ছে না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবা-মা, শিক্ষক, স্কুল আর রাষ্ট্রের সম্মিলিত চাপে নিষ্পেষিত শিশুর মেজাজ যাচ্ছে রুক্ষ হয়ে। তারপর তার ঠিকানালোভী ডাক্তারের ক্লিনিকে। বুদ্ধিজড় শিশু বেছে নিচ্ছে মাদক, না হলে সাইবার সাইটে ডুবে যাচ্ছে। এভাবে আমরা তৈরি করছি এক নিষ্ঠুর প্রজন্ম।

এর চেয়েও ভয়ংকর খবর আসছে প্রতিদিন। আত্মহত্যা। পরীক্ষা, জিপিএর এই ঘোড়দৌড়ে অপমানে, লজ্জায় মৃত্যুকেই একমাত্র উপায় ভেবে ক্রমেই লম্বা হচ্ছে এই আত্মহননের লাইন। এ দায় কার?

বাংলাদেশে এখন প্রজেক্টের প্রতিযোগিতা। প্রজেক্ট মানেই লুটপাটের অবাধ ব্যবস্থা। তাই পদ পেতে মরিয়া শিক্ষক থেকে আমলা পর্যন্ত সবাই। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এঁদের কারও কারও নাম। নাম আছে কিন্তু নেই তার পরিচিতি। কেউ লেখায়, কেউবা সম্পাদনায়। দুর্বোধ্য, অপাঠ্য জঞ্জাল সব। তারা শিশুর ভাষা বোঝেন না, তার শিক্ষার স্তর বোঝেন না, বোঝেন না শিশু মনস্তত্ত্ব। যাঁরা বানাচ্ছেন এসব জঞ্জাল, তার ঠিকুজি থাকতে হবে বইয়ে। আমরা জানতে চাই কোনো যোগ্যতায় এসব জঞ্জাল লিখেছেন তাঁরা।

প্রতিযোগিতা যত খুশি বাড়ান উচ্চশিক্ষায়। বই লেখার এতই যদি শখ, লিখুন উচ্চশিক্ষার বই। সে সামর্থ্য নেই বেশির ভাগ পণ্ডিতের। শিশুকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেওয়াই আদর্শ শিক্ষাক্রম। ফিনল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখুন। চোখ মেলুন শ্রীলঙ্কায়, কোরিয়ায়, মালয়েশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায়, থাইল্যান্ডে, ভুটানে। ভুটানের নাম শুনে নাক সিঁটকাবেন? ভুটান থেকে যোজন-যোজন পিছিয়ে পড়ছে পণ্ডিতি লুটপাটের বাংলাদেশ।

স্যামুয়েল ব্লুমের নাম ভাঙিয়ে, তাঁর তত্ত্বের অপব্যাখ্যা দিয়ে, তাঁর শিক্ষা-স্বপ্নকে ধুলায় মিশিয়ে শিশুদের ওপর এই নারকীয় অত্যাচারের কোনো অধিকার কারও নেই। আমাদের সংবিধান কাউকে এই ক্ষমতা দেয়নি। ইউনেসকোর মানদণ্ডেও তা অমানবিক।

লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039849281311035