জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ২০১৯ সালের নবম-দশম শ্রেণির গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ে পোশাকের শিল্প উপাদান ও শিল্পনীতি অধ্যায়ে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে ত্রুটি হিসেবে বর্ণনা করে গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন অনুযায়ী ফর্সা, শ্যামলা, লম্বা, মোটা, খাটো মেয়েদের জন্য উপযুক্ত পোশাক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ে ‘কৈশোরকালীন পরিবর্তন ও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা’-বিষয়ক অধ্যায়ে যৌন নিপীড়ন থেকে নিজেকে রক্ষায় কিশোরীদের করণীয় প্রসঙ্গে অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, পরিচিত ও অপরিচিত পরিবেশে একা না যাওয়া, কেউ কাছে ডাকলে কয়েক হাত দূরে থাকা, গায়ে, পিঠে হাত দিতে পারে এ রকম সুযোগ না দেয়ার কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। একই বইয়ে কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে সংকোচ দূর করতে ‘উপযুক্ত পোশাক পরিধানের’ পরামর্শ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেও বর্ণ পরিচয় শেখাতে মেয়েদের উপযুক্ত পোশাক হিসেবে শিশুদের ওড়নার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এ পাঠগুলো নারীর প্রতি প্রচলিত গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং স্বাধীন-স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নারীর মানবিক মর্যাদাবোধের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। উল্লেখ্য, প্রায় প্রতিটি পাঠ্যপুস্তকের প্রসঙ্গ কথায় পাঠ্যপুস্তকগুলোর বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই উল্লিখিত পাঠগুলো প্রসঙ্গ কথার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এর মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে যে শরীরসর্বস্ব ভোগ্য বস্তু হিসেবে দেখা হয়, সেই বোধেরই প্রতিফলন হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর শরীরই নারীর প্রধান সমস্যা এবং নারীর নিরাপত্তাহীনতার জন্য নারী নিজেই দায়ী—এ বার্তাই দেয়া হয়েছে এবং এ ধরনের একপক্ষীয় পরামর্শ নিজের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে একটি মেয়েকে ক্রমেই গুটিয়ে নেয়ার শিক্ষা দেয়।
প্রসঙ্গ কথার অনুসরণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার জন্য শুধু গার্হস্থ্যবিজ্ঞান নয়, সব পাঠ্যপুস্তকেরই বিষয় নির্বাচন, উপস্থাপনের ভাষা, ছবির ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা প্রয়োজন। কেননা অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মানসচরিত্র গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। একটি মেয়েশিশুকে আত্মবিশ্বাসহীন সনাতন নারী করে এবং ছেলেশিশুকে কর্তৃত্বপরায়ণ পুরুষ করে তুলতেও পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি একজন ছেলেশিশুকে মানবিক, নারীর প্রতি সংবেদনশীল করে তুলতে এবং একজন মেয়েকে আত্মবিশ্বাসী মানুষে পরিণত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে অষ্টম শ্রেণির কিছু পাঠ্যবইয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। ওই শ্রেণীর কয়েকটি পাঠ্যবই পর্যালোচনায় নারীর ভূমিকা-সম্পর্কিত বিভিন্ন ইতিবাচক তথ্য, ইমেজের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন বাংলা প্রথম পত্র বইয়ে নারী শিরোনামে কাজী নজরুল ইসলামের গাহি সাম্যের গান কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সমাজ গঠনে নারী-পুরুষের পরিপূরক ও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একই শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে সারাংশ ও ভাব সম্প্রসারণ হিসেবে ‘গাহি সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী— অর্ধেক তার নর’ ইত্যাদি উক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। একই বইয়ে শব্দার্থ সম্পর্কে বিভিন্ন উদাহরণ দিতে গিয়ে ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে ‘জাগো নারী, জাগো বহ্নি শিখা’ উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মেয়েরা আত্মপরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠার তাগিদ পাবে।
একই শ্রেণীর ইংরেজি প্রথমপত্র বইয়ে শামীমা, রুনা নামের দুজন নারীর স্বনির্ভর হিসেবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইংরেজি ব্যাকরণ ও কম্পোজিশন বইয়ে রিনা নামের একটি মেয়ের ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ট্রেনিং নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার গল্প এবং সুমনা ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট/ মায়া কিকড দি বল/ হার জিনস আর ব্ল্যাক উদাহরণগুলোর উল্লেখ ইতিবাচক। কেননা এ উদাহরণগুলোর মাধ্যমে মেয়েরা যে সুন্দরী না হয়ে মেধাবী হতে পারে, বল খেলায় অংশ নিতে পারে, সে রকম মানস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
অন্যদিকে বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে শব্দার্থের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতে ‘বাবা মাছের মুড়োটি ছেলের পাতে তুলে দিলেন’, ‘মেয়েটির চেহারা এত ভালো যে কী বলব?’ ‘তিসা নাকে নথ পরেছে’, ‘রোমানার গায়ের রঙ ফর্সা’ ইত্যাদি উক্তির ব্যবহার ষষ্ঠ ও নবম-দশম শ্রেণীর গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ের মতো মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যই আসল এবং বিপরীতে মাছের মুড়ো খেয়ে ছেলেসন্তান বুদ্ধি ও শারীরিক শক্তিকে বলীয়ান হবে—এ বার্তাই দেয়।
ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের প্রচ্ছদে কাঁধে বন্দুক নিয়ে নারীদের মার্চপাস্টের ছবিতে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ইতিহাস বর্ণনায় নারীরা যে নির্যাতিত হয়েছেন, তার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু নারীরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন, তার উল্লেখ করলে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা অর্জনে নারীরা যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তার একটি পরিপূর্ণ চিত্র পেত। এ বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে সামাজিকীকরণ ও উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। এখানে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কীভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-প্রথার মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য স্থায়িত্ব লাভ করে, সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়ার সুযোগ ছিল। একই বইয়ের দশম অধ্যায় বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনায় নারী নির্যাতন কিশোর অপরাধের আওতাভুক্ত সমস্যা হিসেবে আলোচিত হয়েছে, বাস্তবে যদিও নারীর প্রতি সহিংসতায় শুধু কিশোররাই নয়, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরাও সমানভাবে সম্পৃক্ত থাকে। এ অধ্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদের স্বাধীন মতামতকে শ্রদ্ধা করা, নিরাপদ চলাফেরার নিশ্চয়তায় সমাজের পুরুষদের প্রত্যাশিত ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা থাকার প্রয়োজন ছিল।
একই শ্রেণির গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে বয়ঃসন্ধিকাল, পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পাঠ বিষয়ে লিঙ্গ অনুযায়ী আচরণের আলোচনায় খুব সংগতভাবে মেয়েদের মতো আচরণ করার জন্য চাপ দেয়া, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, একা কোথাও যেতে না দেয়া, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মেলামেশায় আপত্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো যে মতবিরোধ ঘটায়, তার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মা-বাবার কী করণীয়, তা বলা হয়নি। তবে এই শ্রেণির গার্হস্থ্যবিজ্ঞান বইয়ে শারীরিক সৌন্দর্য নয়, পেশা, উপলক্ষ, মৌসুম, কৃষ্টি, জাতীয়তা অনুযায়ী পোশাক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে।
‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’—নারীবাদী লেখক সিমন দ্য বুভোয়্যার একটি বিখ্যাত উক্তি। শুধু জৈবিক পার্থক্যের সূত্র ধরে কীভাবে একজন মানবশিশু ক্রমে তারই সমান্তরাল অন্য একটি মানবশিশু থেকে আলাদা হয়ে একটি ভিন্ন জীবে পরিণত হয়, হয়ে ওঠে নারী, সেই কথাই বলা হয়েছে এ উক্তির মাধ্যমে। মূলত সন্তান জন্মদানের সক্ষমতাকে অজুহাত করে বিভিন্ন আচার, প্রথা, বিশ্বাস, আইনকানুন অনুসরণ ও প্রতিপালনের মাধ্যমে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, রাষ্ট্র একজন মেয়েশিশুকে ক্রমে পুরুষের আজ্ঞাবহ চার দেয়ালে বন্দি দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষ করে তোলে। এভাবেই সমাজ ও ধর্মের আবরণে জারি করা হাজারো নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে নিজের অজান্তেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ধারক-বাহক হয়ে পরনির্ভরশীল নারী হয়ে ওঠে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বঞ্চনা, বৈষম্যের শিকার হয়ে, এ সমাজের অংশীদার না হয়ে সমাজের অধীনস্থ একজন হয়ে ওঠেন নারী।
এ বাস্তবতায় নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে আইন ও নীতি সংস্কারের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ, প্রথা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং সংশোধনের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্ধারণ, ভাষার ব্যবহার, তথ্যচিত্রের উল্লেখসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নারীর মানবিক মর্যাদাবোধ, সমতা ও বৈষম্যহীনতার নীতিকে সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।
দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষ নয়, সমমর্যাদার মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাঠ্যপুস্তকগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা থেকে একটি মেয়ে আত্মনির্ভরশীল, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমান অংশীদারিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা এবং একটি ছেলে মানবিক বোধসম্পন্ন, নারীর স্বাধীন সত্তার প্রতি সংবেদনশীল এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সমর্থক হিসেবে বেড়ে ওঠার শিক্ষা পেতে পারে।
লেখক: আইনজীবী
সূত্র: বণিকবার্তা