নিশীথের তারা হয়ে রাসেল বাংলার ঘরে ঘরে দীপ হয়ে জ্বলছে - দৈনিকশিক্ষা

নিশীথের তারা হয়ে রাসেল বাংলার ঘরে ঘরে দীপ হয়ে জ্বলছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শেখ রাসেল ছিল এক নিষ্পাপ শিশু। ছাপান্ন বছর আগে আজকের এই দিনে গভীর নিশীথ রাত দেড়টায় ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক বত্রিশ নম্বর বাড়ির দোতলার উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরে তার আগমন ঘটেছিল। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য রাজনীতিতে তুমুল ব্যস্ত তার পিতা তখন স্বৈরাচার আইয়ুব খানকে থামাতে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারকর্মে বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে। দীর্ঘ বিরতির পর তার এ শুভাগমন চার ভাইবোনকে পরম পাওয়ার আহ্লাদে আটখানা করেছিল। রোববার (১৮ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, তার বাবা-মা ছিলেন নোবেলজয়ী দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, ইতিহাসবেত্তা ও সুসাহিত্যিক বার্ট্রান্ড রাসেলের পার-ভক্ত। সে সময়ে যুদ্ধংদেহি মার্কিন-রুশ প্রেসিডেন্টকে শান্তির টেবিলে সমবেত করে বিশ্ববাসীর মনে দারুণ আশা জাগিয়েছিলেন তিনি। তার নামের সঙ্গে মিল রেখে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ পারিবারিক উপাধি শেখ যোগ করে ছেলের নাম রাখা হল শেখ রাসেল। মায়া আর মমতায় মন্দ্রীভূত ছিল তার মুখটা। শুধু তার জন্য বত্রিশ নম্বর জনপথ সেদিন থেকে প্রকৃত-প্রফুল্ল মায়াকাননে কল্লোলিত হয়েছিল। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, জ্ঞাতি-স্বজন, প্রিয়জন-পরিজন শুধু নয়; জাপানের সম্রাট থেকে শুরু করে এমন কেউই ছিল না, যে তার অমন মায়ার ভেলায় ভাসেনি।

রাসেলের সবকিছুতে বাড়ির সবার ছিল অসীম কৌতূহল। তার কান্না-হাসি, হামাগুড়ি দেয়া, হাঁটিহাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখা, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, ঘুম-নির্ঘুম, আলস্য-অধীরতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আশা-আকাক্সক্ষা সবার ওপরে স্থান পেত। সে ছিল সবার মধ্যমণি। ঢেঁড়স ভাজির সঙ্গে চিনি দিয়ে রুটি খেতে বালক রাসেল খুব পছন্দ করত; আর সারাক্ষণের কর্মসহযোগী আম্বিয়া বুয়ার কোলে বসে ঘুরে ঘুরে খাবার খেতে ভারি মজা পেত। পোষা পাখিকে এত ভালোবাসত যে, নিজের হাতে পালা কবুতরের মাংস কেউ কোনোদিন তাকে ভুলেও খাওয়াতে পারেনি। পোষা কুকুর টমির সঙ্গে সে কী ভাব ছিল তার! নিজের প্রিয় খাবার দিয়ে টমিকে আপ্যায়িত করতে ভালোবাসত সে। অসম বয়সী সহায়ক কর্মী রমা এবং প্রতিবেশী দুই ভাই আদিল ও ইমরানের সঙ্গে খেলতেও অনেক পছন্দ ছিল তার। পিঠাপিঠি বয়সের ভাগ্নে জয়ের সঙ্গে খেলনা নিয়ে খুনসুটি করতে দারুণ মজা পেত সে। তার বন্ধুপ্রিয়তা উপভোগ করার জন্য মুখিয়ে থাকত টুঙ্গিপাড়ার সমবয়সী বন্ধুকুল। লাঠি-লজেন্স শুধু নয়, তাদের জামা-কাপড় উপহার দেয়ার জন্য মায়ের কাছে বায়না থাকত তার। তাদের উচ্ছ্বাসে ভরা খুশি দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে যেত সে।

বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে দল ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত পিতাকে একদম কাছে পেত না সে। তাই দিনভর মা, ভাই, বোন, বুয়াদের কাছে থেকে রাতের বেলা কিছুতেই পিতাকে ছাড়তে চাইত না। বাড়িতে মেহমান এলে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন করত; এমনকি গৃহশিক্ষককে ঠিকমতো আপ্যায়িত করা হল কিনা, সেদিকে কড়া নজর থাকত তার। তার রাজনীতিবিদ পিতা থাকতেন হয় জেলের অন্দরে, নয়তো বাংলার নানা প্রান্তরে। সেই ক্রান্তিকালে সারা বাড়ি পিতাকে খুঁজে ফিরত সে। পিতার অবর্তমানে বেদনায় ভরা চোখ দুটি তার জলে ভিজে থাকত। পনেরো দিন অন্তর জেলখানায় পিতাকে দেখতে গিয়ে আর আসতে চাইত না সে। বেশ কষ্ট করেই সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে হতো তাকে। পিতার অবর্তমানে মাকেই আব্বা বলে ডাকত সে।

গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যেদিন ভেসে গেল, নির্দোষমুক্ত মুজিব যেদিন বাড়ি ফিরলেন, পুনরায় হারানোর ভয়ে সেদিন থেকে খেলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার পিতাকে দেখে যেত সে। একাত্তরের উত্তাল মার্চের অসহযোগের দিনগুলোতে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুলিশকে ‘ও পুলিশ কাল হরতাল’ বলে উত্তেজিত করে দারুণ মজা পেত। রয়ে রয়ে স্লোগান দিত- ‘জয় বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পিতা ও ভাইদের জন্য বোবাকান্নায় বিভোর থাকতে দেখা গেছে তাকে। কান্নাভেজা চোখ কেউ দেখলে বা ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞাসা করলে সে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য বলত- ‘চোখে ময়লা’। বন্দিদশাতেও নির্ভীকতার সঙ্গে জানালা দিয়ে পাক সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করা পরখ করত, এয়ার রেইড চলাকালে ‘ডগফাইট’ দেখে হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করত।

তার সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি। সদ্য স্বাধীন মুক্ত দেশে পিতাকে কাছে পেয়ে সে কী আনন্দ তার! সেদিন থেকে পিতাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। পিতাও তাকে দেশ-বিদেশে যেখানে-যেখানে নেয়া সম্ভব, সেখানেই নিয়ে যেতেন। আবার সে মাকে ছেড়েও কোথাও থাকতে চাইত না। বোন রেহানা সঙ্গে থাকার পরও সেবার জাপান সফরকালে মায়ের শূন্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল সে। বড় দু’ভাইয়ের বিয়েতে বোন ও জ্ঞাতিদের সঙ্গে ভাইদের পাশাপাশি থেকে অনিঃশেষ আনন্দে মেতেছিল।

প্রভাতের শুভ্র নির্মলতা নিয়ে শিশু রাসেলের নিষ্পাপ জীবনের সূচনা ঘটেছিল। ঘাতকদের নিশিথ রাতের কদর্য-কালিমায় তার নশ্বর দেহের প্রাণের লীলা সাঙ্গ হয়েছে বটে; কিন্তু রাতের পর নতুন সূর্যের আলো যেমন উদ্ভাসিত হয় পুষ্পিত ও স্নিগ্ধ সৌরভ নিয়ে, তেমনি দিনান্তে নিশীথের তারা হয়ে রাসেল বাংলার ঘরে ঘরে দীপ হয়ে জ্বলছে। তার কোনো মৃত্যু নেই, দিব্যধামে আর অমৃতলোকে তার বসবাস। কবি মোহাম্মদ সাদিকের ভাষায়- ‘অমৃতের পুত্ররা মরে না, মরে মরে বার বার জেগে ওঠে’।

লেখক : ড. সেলিম আকন্দ, শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077619552612305