ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে প্রতিবাদ চলছে মিটিং, মিছিল, সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট। কারণ গত ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। হামলায় গুরুতর আহত তুহিন ফারাবিকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল, অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তাকে নিউরোলজি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। ভিপি নুরের কক্ষের কম্পিউটার, চেয়ারসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে এক ঘণ্টা ধরে এ হামলার ঘটনা ঘটলেও ডাকসু ভবন থেকে মিনিটখানেক দূরত্বের কলাভবনের নিচতলায় প্রক্টর তার কার্যালয়ে থাকলেও ঘটনাস্থলে আসেননি। হামলা সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আসেন যেমনটি আমরা বাংলা সিনেমায় দেখতে পাই, ঘটনা শেষ তখন পুলিশ উপস্থিত। ডাকসুর ভিপি হওয়ার আগে-পরে নুরুল হক নুর ও তার সহযোগীদের ওপর অন্তত নয়বার হামলা করেছে সরকারি ছাত্র সংগঠন। আর এর মধ্যে পাঁচবারই হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনই হামলাকরীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যখন খোদ ভারতসহ সারাবিশ্বে প্রতিবাদ হচ্ছে, যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য। অথচ ঢাবি ক্যাম্পসে নুরের নেতৃত্বে যখন তারা প্রতিবাদ শুরু করল, তাদের ওপর হামলা করা হলো। নুরের কার্যালয়ে আলো নিভিয়ে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, সেটি সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়। হামলাকারীরা ডাকসুর ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। চরম বর্বরতা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে গ্রাস করে ফেলছে অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো হুঁশ যেন হচ্ছে না। সবাই মৌখিক বক্তৃতা দিয়ে যাচেছন এবং ডিপ্লোমেটিক কথাবার্তাই বলছেন। এর দ্বারা যে কিছুই অর্জিত হয় না, হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় সে কথাও কেউ ভাবতে চান না।
বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মুক্তিযুদ্ধ। অথচ এই শব্দটি ব্যবহার করে কত অমানবিক কাজ করা হচ্ছে সে কথাও যেন কেউ ভাবতে চাচ্ছেন না, বরং নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামীয় সংগঠনটিকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে করে সন্ত্রাস করার অধিকার কে দিলো, অমারা বুঝতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার করে কারও ওপর নিপীড়ন কিংবা হামলা করলে সেটি বৈধ হয়ে যায়? গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও তারা তা করেনি। মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে এমন হামলা মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট অপমান।’ ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘এই রকম বর্বরতা আমি আমার ছাত্ররাজনীতিতে দেখিনি। বাংলাদেশ আমলে কবে দেখলাম তাই ভাবছি, পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। এইরকমভাবে বেধড়ক পেটানো মৃত্যু সমতুল্য। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডাকসু ভিপি মানে তো সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে এমন তো না। আগে তো ছাত্রলীগ পেটাতো, এখন নতুন সাইনবোর্ড মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে সেটা করা হলো। এটা খুব দুঃখজনক।’ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন প্রশ্ন রেখে মান্না বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কাজ? তাদের ডাকসু ভিপির বিরুদ্ধে যেতে হবে কেন?এইগুলো তো আমি বুঝতে পারছি না।’ আমরাও বুঝতে পারছি না, এরা কারা? কেন বার বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপর হামলা হচ্ছে? আবার মুক্তিযুদ্ধের মতো শব্দ ব্যবহার করে। মুক্তিযুদ্ধের কতবড় অপমান এটি সেটি আমরা কি কেউই খেয়াল করব না? এর পেছনে কার স্বার্থ রয়েছে, কিসের স্বার্থ কিছুই বুঝতে পারছি না!
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদ, মিছিল, সভা, সমাবেশ চলছে। বরিশাল বিএম কলেজে বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধন করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ নামে একটি সংগঠন। মিছিলকারীরা ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেক বার; লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে; ছাত্র সমাজ এক হও; নুরুর ওপর হামলা কেন প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি বলে স্লোগান দেয়। এই স্লোগান তো আমাদের আরও কনফিউজ করে দিল? এত দেখছি মারাত্মক রাজনৈতিক চাল? কারা চালছে এই চাল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে?
‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক সংগঠনটি নিবন্ধিত নয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর এই সংগঠনটি গঠন করা হয়। কোটা বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি হলে শাহবাগে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানেরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের মধ্যেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে সংগঠনটি গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিনকে সংগঠনটির আহ্বায়ক এবং সাবেক সড়ক ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খানকে সদস্যসচিব করা হয় আর চলতি বছর মার্চে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদবঞ্চিত নেতা আমিনুল ইসলামকে সভাপতি ও আল মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গঠন করেন জামাল উদ্দিন।
ডাকসু ভিপি নুরুর হক নুর ও তার সহযোগীদের ওপর হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়ার দাবিতে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে ২৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত বিক্ষোভ সামবেশ থেকে জড়িতদের বহিষ্কারেরও দাবি জানানো হয়। হামলাকারীরা দাবি করেন যে, সিসিটিভিতে হামলাকরীদের ফুটেজ রয়েছে, অবিলম্বে তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হোক। ইতোমধ্যে জানা যায় যে, ডাকসুতে নয়টি সিসি ক্যামেরা থাকলেও ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নুরের কক্ষ আটকে মারধরের পর পরই সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ হার্ডডিস্ক, মনিটর ও সিপিইউ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কে বা কারা নিয়ে গেছে এগুলো তাও কর্তৃপক্ষ বলতে পারে না। সে কাজ করতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তি আরেকবার প্রস্ফুটিত হবে। প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।
২২ডিসেম্বর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ভিপি নুরকে দেখতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য। নুরের সঙ্গে দেখা করতে প্রথমে উপাচার্যকে বাধা দেয়া হয়। এ সময় উপাচার্য ও প্রক্টরকে দালাল আখ্যা দিয়ে তাদের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘আপনার শিক্ষকতার সম্মানকে ধূলিসাৎ করেছেন। সরকার ও ছাত্রলীগের পক্ষে আর কত দালালি করবেন। দায়িত্ব না নিতে পারলে পদ ছেড়ে দিন।’ ভিপি নূর গণমাধ্যমকে বলছে, ‘আমরা যেহেতু ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করি, এ কারণে ক্ষোভটা আমাদের ওপর বেশি। মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা তো আগেও হয়েছে। কিন্তু এবার যেটা করেছে একেবারে হত্যাচেষ্টা। আমার ওপর তিনবার হামলা হয়েছে, আহত না হওয়া পর্যন্ত তা চলেছে।’ তুহিন ফারাবিকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে নিউরোলজি বিভাগে নেয়া হয়েছে তাকে। ভিপি নুরুল হকের মতাদর্শ, রাজনীতি কিংবা তাঁর রাজনৈতিক ঘরানা নিয়েও ভিন্নমত বা বিরোধিতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত। তাকেই ছাত্রছাত্রীরা দেখতে চান ডাকসু ভিপি হিসেবে। তাকে দফায় দফায় মেরে কি অর্জন করতে চায় বিশেষ একটি সংগঠন তা আমাদের বুঝে আসছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এ হামলার ঘটনায়। এ ঘটনাটি কেন ও কীভাবে সংঘটিত হলো এবং এর সঙ্গে কারা জাড়িত তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার জন্য কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা জানি বা অতীতেও দেখেছি তদন্ত কমিটি করা মানে কোনো কিছুকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেয়া। আর কমিটির রিপোর্ট যদি তাড়াতাড়ি দিতে বলা হয়, সেটি করা হয় অত্যন্ত সুচতুরভাবে, ডিপ্লোমেটিক ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে। এতে না থামে এ ধরনের ঘটনা, না হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো লাভ। এতে লাভ একটিই হয়,সেটি হচ্ছে অরাজকাত বাড়তেই থাকে। কারণ সন্ত্রাস যারা করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেয়া মানে আরও সন্ত্রাস করার জন্য তাদেরকে পুরো লাইলেন্স দিয়ে দেয়া। আমরা পত্রিকায় দেখলাম ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নেত্রী সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা যদি দলীয় পরিচয়ের কেউও হয়, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বলা হয়েছে।’ আমরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো হিসেব যেহেতু বুঝি না, আমরা শুধু এতটুকু বুঝি যে, ঘটনা যারাই ঘটাক তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা অপেক্ষায় আছি যে, রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে।
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ।