দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী বিথীর কাছে বাবার মুখটিও এখন অস্পষ্ট। মা থেকেও নেই। স্কুলে, রাস্তায় যখন কোন বাবা-মা শিশুকে আদর করতে দেখে তখন অপলক চেয়ে থাকে বিথী। কষ্টে তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও সান্ত্বনা দেয়ারও কেউ নেই। বৃদ্ধ নানা-নানীকে দু’মুঠো খাবারের জন্য সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হয় কখনও মাঠে, কখনো অন্যের বাড়িতে। তাই মাত্র নয় বছর বয়সেই একাকী বিথী বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ না পাওয়ার হাহাকার, কষ্ট ও যন্ত্রণা বুকে চেপে পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে নানী সেতারা বেগম ও নানা হানিফ মাতুব্বরের আদরে বেড়ে উঠছে বিথী ও তার স্বপ্ন। হাজী আফসার উদ্দিন মুন্সী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার দ্বিতীয় শ্রেণির এ ছাত্রীর পিতা মোক্তার হোসেন যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যারন, তখন বিথীর বয়স মাত্র চার। বাবার মৃত্যু শোক না ভুলতেই এক বছরের মাথায় বিথীকে নানার কাছে রেখে মা লাইলী বেগম দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যায়।
সদা হাস্যোজ্জ্বল মায়াবী বিথীর মুখটি সন্তান কোলে কোন বাবা-মাকে আদর করতে দেখলেই অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে যায়। চোখদুটো জলে ভিজে যায় তার। বিথীর ভাষায়, মায়ের কাছে আমি তো বোঝা। আব্বায় মরার পর মাও জানি ক্যামন হইয়া গ্যাছে। হেইয়ার লাইগ্যা আমারে হালাইয়া (ফেলে রেখে) থুইয়া গ্যাছে।কবে যে মায়ের কোলে বইয়া ভাত খাইছি, ঘুমাইছি কিচ্ছু মনে নাই। মায়ের গায়ের গন্ধটা ভুইল্লা গেছি। আমাগো বাড়ি-ঘর সবই ছিলো। হেই বাড়তে এ্যাহন কেডা থাহে জানি না। বাড়িডা ক্যামন মনে নাই। অথচ এক সময়ে সুখের সংসার ছিলো বিথীদের এ কথা বলেন মাদরাসার ক্কারী শিক্ষক মো.এরশাদুল্লাহ।
এখন পাঠ্যবই হলো বিথীর কাছে বাবা-মায়ের না পাওয়া ভালবাসা। মাদরাসা ছুটি শেষে সারাদিন ঘরে বসে বই পড়েই সময় কাটে তার। পাঠ্যবইয়ে বাবা-মা ও সন্তানের প্রতীকী ছবি দেখলেও কেঁদে উঠে বিথী। বিথী জানায়, নানা-নানী আমারে নিয়ে যে কষ্ট করছে লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে এ বৃদ্ধ নানা-নানীর পাশে দাঁড়াতে চাই। মায়ের অবহেলা ও ভালবাসার অভাব তাকে কখনও নানা-নানী বুঝতে দেয়নি ।
বিথীর নানী সেতারা বেগম বলেন, বিথীর বাবা মইর্যা যাওয়ার পর একটা বছর মাইয়ারে নিয়া অর মায় (লাইলী বেগম) ঢাকায় ছিলো। হেইয়ানে হারাদিন নাতনীডারে (বিথী) ঘরে তালা দিয়া থুইয়া কামে যাইতো লাইলী। তহন অর বয়স চাইর বছর। ছোট্র নাতনীডা হারাদিন কানতো (কাঁদতো)। এই খবর মাইনষের কাছে হুইন্না(শুনে) অরে আমরা লইয়া আই। তিনি বলেন, বিথীর বাপটা মরার পর চাচারাও কেউ খোঁজ নেয় না। মাইয়াডা পড়তে চায়, মাদরাসায় যাইতে চায়। আমাগো তো প্যাট(পেট) চালাইন্নাই (খাবার খাওয়া) কষ্ট। হ্যারপরও মাইয়াডারে ভর্তি করছি। খাতা-কলম কিইন্না দিতে পারি না।মাদরাসা থেকে কিছু দেয়। বাকিডা মাইনষের ধারে চাইয়া চিইন্নাা (চেয়ে) লই।
ঈদ যায়, কোরবানী যায় অরে না কিইন্না দেতে পারি নতুন জামা, না খাওয়াইতে পারি একটু গোসত। নাতনীডার এ্যাতে কোন দুঃখ নাই, আপসোস নাই। ও চায় খালি ল্যাহাপড়া করতে। আমরা বুড়া হইয়া গ্যাছি। কয়দিনই আর বাচুম। আমরা যতদিন বাইচ্চা আছি ততোদিনতো অরে পড়ামু। কিন্তু হেইয়ার পর কে দ্যাখবে অরে। অরতো বাবা নাই। মা থাইক্কাও নাই এ কথা বলেই কেঁদে ফেলে সেতারা বেগম।
মাদরাসা সুপার মাওলানা মো.নেছারউদ্দিন জানান, মাদরাসা থেকে অসহায় দুস্থদের বই-খাতা দেয়া হয় এবং তারা অবৈতনিক। বিথীকেও তারা সাধ্যমতো সহায়তা করছেন। মেয়েটা এতিম এবং খুবই মেধাবী। তাকে যদি কেউ সহায়তা করে তাহলেই কেবল সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে। কেননা বৃদ্ধ নানা-নানীই এখন তার শেষ সম্বল ও বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়।