পাস যেন পাশ না হয় - Dainikshiksha

পাস যেন পাশ না হয়

গোলাম কবির |

মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পাঁচ আর পাসের প্লাবনে গোটা দেশ ভাসছে। পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বেজায় খুশি। এমন খুশি যে নিবিড় আনন্দে চোখের জলে হাসছে। যাকে বলে আনন্দাশ্রু। এই আনন্দাশ্রু অবিলম্বে যন্ত্রণা আর ক্ষোভের চোখের জল ও নাকের পানি এক হয়ে দেখা দেবে, তা কেউ ভেবে দেখার সময় পায়নি।

১৯৪৭ সাল-পূর্ব বাংলায় তখনকার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল যেমন ছিল। বিভাগোত্তর কালের ষাটের দশক পর্যন্ত সময় ও সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছিল প্রায় একই রকম। তখন বড়জোর শতকরা ৩০ জনের পাস করাকে ভালো ফল বলে মনে করতেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সে সময় প্রথম বিভাগের দেখা মিলত কদাচিৎ। গত শতকের সত্তরেব দশকের পর পাসের হার বাড়তে থাকে। এ নিয়ে শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবিত পণ্ডিতরা মুখর থাকতেন। তাঁদের অন্যায়ভাবে বলা হতো রক্ষণশীল। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ প্রকৃতির কিছু মানুষ বোঝার চেষ্টা করেন না, পাসের হার বাড়লেই মেধা বিস্তৃত হয় না। তা ছাড়া পাস করলে যে শিক্ষিত হয়ে ওঠে না, সে ভাবনাও অমূলক।

বর্তমান দুনিয়ায় অনেক দেশ আছে, যেখানে একটা পর্যায় পর্যন্ত পাস-ফেল নেই। তারপর একটা পর্যায়ে শক্ত করে বাঁধন দেওয়া হয়। জনগণের টাকায় অপ্রয়োজনীয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে কিংবা ব্যবসায়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার বারোটা বাজানো হয় না।

আমরা গদগদ হয়ে পুলকিতভাবে অপরিকল্পিত পাস করিয়ে চলেছি। শোনা যায়, উত্তরপত্রে কিছু লিখলেই নাকি নম্বর দেওয়ার অলিখিত নির্দেশ থাকে। ভুল-শুদ্ধ খতিয়ে দেখার উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব। যাঁরা উত্তরপত্র মূল্যায়নে শ্রম দেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় পাসের হার বাড়িয়ে অধিকাংশ শিক্ষাহীন পাসকে সমাজে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এরা কায়িক শ্রম দিতে শেখেনি। মেধার বলেও বলীয়ান নয়। অথচ স্বপ্ন দেখছে, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ এর। এরা বোঝে না পাস করা মানে কিছু সনদ জোগাড় করে মাস গেলে বেতন পাওয়ার চাকরি মেলা নয়। পাস করে জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সমাজ, দেশ ও বিশ্বমানবতার জন্য সামান্য হলেও কিছু অবদান রেখে যাওয়া। তবে সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে ওপরে ওঠার। আমাদের পাস করা সন্তানরা সেই স্বপ্নই দেখবে। তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ভার নিতে হবে জাতিকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে কিছু বেকার সনদধারীকে পুনর্বাসন করলেই চলবে না। দেশের অনিবার্য কাজে যাদের নিয়োগ করা যাবে, তাদের বাছাই করে নিয়ে সত্যিকার শিক্ষকের মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হবে।

একটা বিষয় বিস্ময়করভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠছে, পাস করাদের যাদের হাতে অর্পণ করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই বেধাবী বা শিক্ষানুরাগী নয়। ফলে দেশে পাসের হার বাড়ছে। তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত নাগরিক বাড়ছে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ সংগ্রহের পর মূল সমস্যা কর্মসংস্থান। কোথাও একটি পদ শূন্য হলে শত শত উমেদার। শোনা যায়, সরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেকেরই বাঞ্ছিত কর্মসংস্থান হচ্ছে না (সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা দুর্ভাগাদের প্রসঙ্গ নাই বা তুললাম)। এরা বিদেশে পাড়ি জমাবে! সেখানেও আগের মতো চাহিদা নেই। তাহলে আগামী পাস করাদের দাঁড়ানোর ঠাঁই কোথায় হবে? গত শতকের ষাটের দশকে সমাজতান্ত্রিক চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল। তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ক্ষেত-খামারের কৃষক, কলকারখানার শ্রমিক—সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য, সব শ্রেণির মানুষ বুঝুক, বেঁচে থাকার সংগ্রাম কুসুমাস্তীর্ণ নয়।

আমরা অনেকটা শ্রমবিমুখ। তাই তথাকথিত উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে অপেক্ষাকৃত সুলভ শিক্ষকতার চাকরিতে আসছি। আমাদের রুটি-রুজির সংস্থান হচ্ছে। আমাদের পাস করা অনাগতদের কী হবে? তাদের কাছে ‘পাস’ ‘পাশ’ হয়ে দাঁড়াবে না তো! এ সত্য কী আমরা উপলব্ধি করছি।

সংশ্লিষ্ট সবার বোঝা উচিত, অধিক নম্বর পেয়ে পাস করার চেয়ে জ্ঞানবান ও সুশীল হওয়া উত্তম এবং অতিউত্তম সত্যিকার জ্ঞান লাভের পর যথাযথ স্থানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া।

আমরা শিরোনামে পাস ও পাশ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি। একটি ইংরেজি, অন্যটি সংস্কৃত। ইংরেজি পাস (pass) শব্দের অর্থ সাফল্য লাভ, অনুমতিপত্র, ছাড়পত্র ইত্যাদি। আর সংস্কৃত পাশ শব্দের অর্থ অনেক। তার মধ্যে বন্ধন, ফাঁস, ফাঁদ, জাল, রজ্জু ইত্যাদি অধিক অর্থবহ। লেখা বাহুল্য, এ দুটি শব্দের আংশিক উচ্চারণ ব্যতীত অর্থের কোনো মিল নেই। আমাদের সন্তানরা পাস করে কী পাশ-এর খপ্পরে পড়ে গন্তব্যহীন পথে যাত্রা করবে? জাতির সামনে এ চিন্তা মারাত্মক ব্যাধির মতো সমাসীন। এখান থেকে রক্ষা পেতে হলে শিক্ষার আগাছা অবশ্যই নির্মমভাবে উপড়ে ফেলতে হবে। অতঃপর জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে দেশ ও শিক্ষা এগিয়ে যাবে। তখন পাস আর পাশ হয়ে দেখা দেবে না।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035128593444824