প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক - Dainikshiksha

প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক

মাছুম বিল্লাহ |

মীর মশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘অর্থ! হায়রে পাতকী অর্থ, তুমিই সকল অনর্থের মূল। ভ্রাতা-ভগ্নিতে কলহ, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, পিতা-পুত্রে বৈরী ভাব, সবই তোমার জন্য। কি কুহক, কি মায়া, কি মোহিনী শক্তি, কি মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম!’ বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সমাজের অভিভাবক, কিছুসংখ্যক শিক্ষক তাঁদের ওপর অর্পিত এবং জাতির পবিত্রতম দায়িত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসসংক্রান্ত একটি সিন্ডিকেট শনাক্ত করেছে পুলিশ এবং দুঃখজনক হচ্ছে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মতিঝিলকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষক। এরই মধ্যে ৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো ১০ জনের নাম উঠে এসেছে। কিভাবে তাঁরা এই অসৎ কাজটি দ্রততার সঙ্গে করেন! পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছার পরপরই মোবাইল ফোনে ছবি তোলা হয়। এরপর তাঁরা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে পাঠাতেন। প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর তৈরি করে আবারও তা অসাধু শিক্ষকদের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।

কমলাপুর শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষকের পরিচালনায় পরিচালিত হতো ‘জ্ঞানকোষ একাডেমি’ নামের কোচিং সেন্টার। তাঁরই নেতৃত্বে পাঁচ বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো। রাজধানীর আরো কয়েকটি স্কুল  যেমন—মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত মানববন্ধন অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমরা এমন একটি পরিবেশের মধ্যে আছি, যা আমরা সব খুলে বলতেও পারি না, সহ্যও করতে পারি না। কিন্তু আমরা আর সহ্য করব না। সত্যিকার অর্থে আমাদের মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক বেশি দরকার। ’ মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক কোথা থেকে আসবে? তাঁরা তো এই সমাজেরই সৃষ্টি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মূলত দুটি প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস হয়। একটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে এবং এই প্রক্রিয়ায় আসল ও ভুয়া—দুই ধরনের প্রশ্নই কেনাবেচা হয়। এই ভুয়া প্রশ্ন পাওয়ার আশায় পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও কিছু অসাধু শিক্ষক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। আমি দেখেছি, মেডিক্যালে পরীক্ষা শুরুর আগে কিভাবে ভুয়া প্রশ্ন পাওয়ার জন্য প্রার্থীরা ছোটাছুটি করে। অন্য প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া। মতিঝিলকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট মূলত অল্প সময়ে প্রশ্ন কেনাবেচা করে আসছে। এই প্রক্রিয়া আঁচ করতে পেরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র সচিবসহ পরিদর্শকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কেন্দ্র সচিবকে কেবল একটি সাধারণ ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। অন্তত এই পদক্ষেপের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। আরো ধন্যবাদ শেষ পর্যন্ত বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য।

আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, ফেসবুকে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়—এমন বিজ্ঞাপন দিতেন আসামিরা। পরে বিভিন্ন চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র আদান-প্রদান করা হতো। প্রশ্ন ফাঁসকারী শিক্ষকরা গোটা শিক্ষক সমাজের মুখে চুনকালি দিয়েছেন। শিক্ষক নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত গোটা শিক্ষকসমাজকে কলুষিত করেছে। ঢাকার নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব শিক্ষক নামধারী অবৈধ ব্যবসায়ীরা কিভাবে ঢুকে পড়েছে, তাও দেখা দরকার। তারা তো শিক্ষকতা করতে আসেনি, পেটের দায়ে যারা চুরি করে, কিংবা বখাটে বনে যাওয়া তরুণ, যারা রাস্তায় ছিনতাই করে, তাদের সঙ্গে এই শিক্ষক নামধারীদের তফাত কোথায়? তাদের দলে আরো এক ধরনের দুর্বৃত্ত রয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের জোর করে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে। ছলে-বলে-কৌশলে ফাঁদে ফেলে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখিয়ে প্রাইভেট পড়ায়, পেটের দায়ে নয়, একের পর এক ফ্ল্যাট কেনার জন্য, নয়তো বিলাসবহুল জীবন যাপন করার জন্য। তারা সব শিক্ষকের একই মানদণ্ড দিয়ে বিচার করে। সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের তারা সমালোচনা করে, কটূক্তি করে, এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধস নেমে এসেছে, মূল্যবোধ দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার মূল হোতা হচ্ছে এসব শিক্ষক। শিক্ষক নিয়োগে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঠিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগের পরে বিষয় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সামাজিকতা, মূল্যবোধ, সততার কঠোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ প্রশিক্ষণ হতে হবে সব শিক্ষকের জন্য বাধ্যতামূলক। যাঁরা জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁদের উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। সব ধরনের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। সবার জন্য শিক্ষকতা পেশা নয়, হৃদয় যাঁদের বড়, উদার ও সৎ গুণাবলিতে ভর্তি, শুধু তাঁদেরই এই পেশায় আসা উচিত।

অনেকে মন্তব্য করেছে এবং পত্রিকায়ও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি মূল্যবোধের চর্চা করে? সরকারের সবচেয়ে বড় এই মন্ত্রণালয় দুর্নীতিতে সেরা। এই মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিভাগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যেখানকার ইট-কাঠ-পাথর সবই ঘুষে ভরা। ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো সেবা নেই। কোথায় পাব আমরা মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরগুলো শুধু আর্থিক দুর্নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নৈতিক স্খলন এখানে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে, কিন্তু কিভাবে? এর উত্তর খুঁজে সঠিক সমাধান বের করতেই হবে।

সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটি বারবার এড়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু এভাবে এড়িয়ে গেলে সমস্যা যে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, সেটি তাদের বুঝতে হবে। সরকার কোনোভাবেই যেন এটি আর প্রশ্রয় না দেয়। সামান্য লাভের জন্য কিংবা পার্টিগত কারণে এদের প্রশ্রয় দিলে গোটা সমাজকে এরা কলঙ্কিত করবে, তাতে দেশ, দশ, জাতি বৃহত্তর ক্ষতির সম্মুখীন হবে।   ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের মতো আন্তর্জাতিক পরীক্ষা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পৃথিবীর ১৬৬টি দেশে একই সময়ে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, অথচ কোনো দিন শোনা যায়নি যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। কখনো কোনো প্রশ্ন রিপিট হয়নি। নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মুখস্থ করে এই পরীক্ষায় পার পাওয়া যায় না। সত্যিকারের ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে হয় এসব আন্তর্জাতিক পরীক্ষায়। আমাদের এসব পরীক্ষা থেকে শিখতে হবে। আমরা ‘বুয়েটের’ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথাও কখনো শুনিনি। আমরা বুয়েটের শিক্ষকদের পরামর্শ নিতে পারি।

এই প্রশ্ন ফাঁসকারী শিক্ষকরা কী শেখাচ্ছেন আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের? যারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে তারা কোন ধরনের শিক্ষকের কাছে পড়ছে, কী পড়ছে, কী শিখছে? এই তরুণ বয়সেই জেনে যাচ্ছে তাদের শিক্ষক কত বড় চোর! কত বড় জালিয়াত! জাতির কত বড় সর্বনাশকারী! এই অপরাধকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

(প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক ও বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত )

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063920021057129