বাকস্বাধীনতার পথ মসৃণ রাখুন - দৈনিকশিক্ষা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনবাকস্বাধীনতার পথ মসৃণ রাখুন

এম হাফিজ উদ্দিন খান |

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পূর্বাপর এ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে এবং আইনটি যে সংবিধান ও বাকস্বাধীনতা পরিপন্থী, তাও বলা হয়েছে স্পষ্ট করে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। দেশ-বিদেশের নানা মহল থেকে আইনটি যাতে পাস করা না হয় এই আহ্বান সরকারের প্রতি বারবার জানানো হয়েছিল। আইনটি পাস হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্রপতির প্রতি এ আহ্বানও জানানো হয়েছে, যাতে তিনি এতে স্বাক্ষর না করে সংসদে ফেরত পাঠান। এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কী পদক্ষেপ নেবেন এটা নিতান্তই রাষ্ট্রপতির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। ইতিমধ্যে তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। 

পত্রিকায় দেখলাম, সম্পাদক পরিষদের কাছে পাঠানো চিঠিতে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ ও বিবৃতি তথ্য মন্ত্রণালয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য অধিকারের প্রতি সরকারের আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা সমুন্নত রেখে বিষয়টির দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকের একান্ত প্রয়োজন। আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে।' সাদামাটা বিশ্নেষণে বলা যায়, তথ্যমন্ত্রী ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা তিনিসহ সরকারের দায়িত্বশীলরা তো আগেই অনুভব করে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে আজ এই বিতর্ক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হতো না। সম্পাদক পরিষদ তথ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে বসবেন কি-না এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াও তাদের বিষয়। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ অধিকতর উদ্বেগান্বিত-উৎকণ্ঠিত এ কারণে যে, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও উৎকর্ষের এই যুগে বাকস্বাধীনতার পশ্চাৎমুখী যাত্রা কেন? 

সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংবিধানবিরোধী- এ কথা আমি ইতিমধ্যে বহুবার বলেছি। এই আইনে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে সম্পাদক পরিষদের বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত হওয়ার কারণে স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ব্যাহত হবে- এ আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপন্ন তা হলে আমাদের সামনে সৃষ্টি হবে আরও নানামুখী প্রতিবন্ধকতা। সমালোচনা করা, কারোর মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজে স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো, (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধসাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।' 

২০০৬ সালে তৎকালীন সরকার একটা রাজনৈতিক ঝড়ো পরিস্থিতি কিংবা হাওয়ার মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা যুক্ত করেছিল। আমাদের স্মরণে আছে, ঠিক এ রকমেরই একটি বিধান ভারত সরকার আইনে যুক্ত করলে এর বৈধতা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল এবং সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল করলে ভারতের তৎকালীন সরকার তা নিঃশব্দে মেনে নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বিগত এক দশকে ৫৭ ধারা বাতিল কিংবা সংশোধনের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বহুবার ব্যক্ত হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের তরফে। ২০০৬ সালে যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন করা হয় তা ২০১৩ সালে সংশোধন করার পর আবার বিতর্ক শুরু হয়েছিল। আইনের ৫৭ ধারা বলে পুলিশকে দেওয়া অধিকতর ক্ষমতা প্রদান এবং আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। নিরাপত্তার পরিবর্তে এ আইন হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছেও। ভিন্নমত দমন, স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৫৭ ধারাকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের পুরনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আরও পুষ্ট করেছে। ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন হলে তাতে দেখা যায়, ৫৭ ধারা নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল তা আগের মতোই বহাল রাখা হয়েছে কিংবা আরও পুষ্ট করা হয়েছে অন্য নামে। 

বাকস্বাধীনতার দরজা উন্মুক্ত রাখতেই হবে। এই দরজা বন্ধ করার কোনো প্রক্রিয়ার ফলই স্বস্তিদায়ক হবে না, শুভ ফল বয়ে আনবে না। সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, আইনজীবী, সুধীসমাজ, পেশাজীবী মহল, মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশ-বিদেশের আরও নানা মহলের আপত্তি সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার এই সরকার কেন এমন পদক্ষেপ নিল তা বিস্ময়কর, যুগপৎ প্রশ্নেরও বিষয়। বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। তারা সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে বিল চূড়ান্ত করে সংসদে জমা দেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এবং সংশ্নিষ্ট আরও অনেকে উপস্থিত হয়ে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা আরও বিশদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব বাতিলের কথা তারা বলেছিলেন। বলা হয়েছিল, বিলের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা বাতিল বা সংশোধন না করলে স্বাধীন সাংবাদিকতায় দেখা দেবে প্রতিবন্ধকতা। সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশে সেসব বিষয়ের উল্লেখ ছিল, তাও পত্রপত্রিকা মারফতই জেনেছি। কয়েকটি ধারায় কিছু পরিবর্তনও আনা হয়। কিন্তু ৩২ ধারাসহ বেশিরভাগ উপধারাই রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা অস্বীকার করব না। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারণে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে। এও সত্য যে, নানা ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগও হচ্ছে। বাড়ছে সাইবার অপরাধও। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য যা কিছু করতে হয়, সেসবই করতে হবে সংবিধানের আলোকে; সংবিধান অবজ্ঞা করে নয়। একই সঙ্গে যা যা করার তা করতে হবে মত প্রকাশের ব্যবস্থা বাধাহীন রেখে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ না করে। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এসব প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক। রাষ্ট্রকে অবশ্যই অবস্থান নিতে হবে বাকস্বাধীনতার পক্ষে। জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইনই কাম্য হতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে যে, এ ধরনের আইন শেষ পর্যন্ত কালো আইন হিসেবেই পরিগণিত হয়ে থাকে। ক্রমেই এগিয়ে আসছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নিয়ে যখন দেশে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক-উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে, তখন এমন একটি আইন পাসের ক্ষেত্রে এত তড়িঘড়ি করা হলো কেন- বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এমন প্রশ্নও উঠতেই পারে। এ দেশের মানুষ চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত বাংলাদেশে সচেতন মানুষ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্যও কম সংগ্রাম করেনি। এসব বিষয় আমাদের নীতিনির্ধারক কিংবা রাষ্ট্র পরিচালকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণে রেখে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় তাদের নিষ্ঠ থাকতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, 'এ ব্যাপারে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।' তিনি এও বলেছেন, 'ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থচিন্তা থেকে বিবেচনা করলে হবে না। সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।' প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য স্বস্তি আপাতত জোগালেও কারও কারও মনে অতীত নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও সংবাদ পরিবেশন করতে পারলে গণমাধ্যম যেমন বিশ্বাসযোগ্য হবে, তেমনি আমাদের অনেক ক্ষত উপশমেও তা হবে সহায়ক। তবে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় যাতে রূপ না নিতে পারে এ ব্যাপারে সচেতন সবাইকে থাকতে হবে অধিকতর সচেতন। উন্নয়নের স্বার্থে, গণতন্ত্রের বিকাশে, সৃষ্ট ক্ষত উপশমের প্রয়োজনে গণমাধ্যমের পথ মসৃণ রাখতেই হবে। এও স্পষ্ট করেই বলতে চাই যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, গঠনমূলক সমালোচনায় অবশ্যই বিশ্বাস করি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধনের বিকল্প নেই- এর সঙ্গেও সহমত পোষণ করি। সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040910243988037