বিতর্কিতরা মুক্তিযোদ্ধার নতুন তালিকায়ও - দৈনিকশিক্ষা

বিতর্কিতরা মুক্তিযোদ্ধার নতুন তালিকায়ও

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মির্জা ইসমত ও আওলাত হোসেনকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে যাচাই–বাছাইয়ের সময় তাঁদের নাম বাতিল তালিকায় রেখেছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের একজন এখন মৃত। অথচ ৩ জুন এই দুজনকে যুক্ত করে নতুন করে ১ হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও যাচাই–বাছাই কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও দেশের যে কয়টি জেলার নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার অনেকগুলো নিয়েই বিতর্ক রয়েছে।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার নতুন ১১ মুক্তিযোদ্ধার অর্ধেকের নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর নরসিংদীর নতুন তালিকা দেখে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এমন আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভালো করে যাচাই–বাছাই না করে এই করোনা দুর্যোগের সময় হঠাৎ নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন প্রকাশ করা হলো, জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জেলা-উপজেলা থেকে যেসব প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, আমরা তা যথেষ্ট যাচাই–বাছাই করে এ তালিকা প্রকাশ করেছি। তারপরও যদি কারও অভিযোগ থাকে, তবে আপিলের সুযোগ আছে।’

এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ—প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সারা দেশে ক্ষোভ–বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে ওই তালিকা স্থগিত করা হয়।  

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের মির্জা ইসমত ও আওলাত হোসেনকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল স্থানীয় কমিটি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই–বাছাইয়ের বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এ দুজনকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘গ’ তালিকায় (বাতিল তালিকা) দেখানো হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্য উপজেলাগুলোতেও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এইচ এম আবদুল কাদির বলেন, ‘উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় মির্জা ইসমত ও আওলাত হোসেনের নাম “গ” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ, আওলাতের কাছে মুজিব বাহিনীর একটি সনদ থাকলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। আর প্রয়াত মির্জা ইসমতের পরিবারের কাছে তাঁর মুক্তিযোদ্ধার কোনো দলিলপত্র নেই। যাচাই–বাছাইয়ে তাঁরা কিছু দেখাতে পারেননি।’

তাহলে তাঁদের নাম কী করে নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো? জবাবে আবদুল কাদির বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।’

ফরিদপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, নতুন তালিকায় অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় নতুন করে ১১ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকার এক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ১১ জনের মধ্যে অর্ধেকের নাম নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে দুজনের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তৎকালীন উপজেলা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এলাকায় সবাই জানেন, তাঁরা অমুক্তিযোদ্ধা। এই দুজন হলেন মফিজুর রহমান খান ও আজিজুল হক মোল্লা।

একইভাবে এ জেলার চরভদ্রাসনে নতুন ছয়জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন অমুক্তিযোদ্ধা। চরভদ্রাসন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক উপকমান্ডার আবুল কালাম বলেন, অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম নতুন তালিকায় প্রকাশ করায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

ফরিদপুর সদরের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল ফায়েজ বলেন, ‘তালিকায় অসামঞ্জস্য আছে। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান যাচাই-বাছাইয়ে ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সদস্যও। তাঁর বিরুদ্ধে কী করে বলব, তাই এ তালিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে বিব্রতবোধ করছি।’

নরসিংদীর সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোতালিব পাঠান বলেন, ‘আমি এ তালিকা দেখে হতবাক। নরসিংদীতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। আমরা চারজনের নাম সুপারিশ করেছিলাম। এখন দেখি সেখান থেকে দুজনের নাম তালিকায় আছে। বাকিদের নাম কোথা থেকে গেল, কারা সুপারিশ করল, কীভাবে করল আমার জানা নেই।’ নতুন তালিকায় নরসিংদী থেকে ১৫ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপর জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়। এরপর আরও সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়। তবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলতে থাকে। সর্বশেষ গেজেটসগ মোট সাত বার তালিকা হালনাগাদের পর মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার। আর এখন যুক্ত হলো আরও ১ হাজার ২৫৬ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৬৬তম সভায় নতুন প্রায় ১ হাজার ৩০০ মুক্তিযোদ্ধার নামের একটি তালিকা অনুমোদন করা হয়। গেজেট প্রকাশের আগে যাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারেননি, তাঁদের নাম বাদ দিয়ে ১ হাজার ২৫৬ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। পর্যায়ক্রমে আরও নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ছয় মাস আগের তালিকা হঠাৎ করে এভাবে প্রকাশ হওয়ায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, এ সময় এভাবে তালিকা প্রকাশ করার অর্থ হলো কেউ যাতে অমুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সমালোচনা বা অভিযোগ করতে না পারে।

জামুকার কয়েকটি সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন দুজন কর্মকর্তা বলেন, সভায় যাচাই–বাছাই করে নতুন অনেকের নাম ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সুপারিশের ভিত্তিতে যুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাগজপত্র সঠিক না থাকলেও স্বজনপ্রীতি করেছেন জামুকার কোনো কোনো সদস্য। এ ছাড়া অনেকের তদবিরও ছিল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো এলাকায় ৮০ থেকে ১০০ জন নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম সুপারিশ করা হয়েছে। এক এলাকায় এত নতুন মুক্তিযোদ্ধা কোথা থেকে এল? বরিশালের একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, যাচাই–বাছাইয়ে যখন যাঁরা ছিলেন, তখনই তাঁরা নিজেদের পরিচিতদের নাম ঢুকিয়েছেন। তবে এটা ঠিক, তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামও আছে।

নতুন তালিকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বগুড়া, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ফরিদপুর, ফেনী, গাইবান্ধা, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, হবিগঞ্জ, জামালপুর, জয়পুরহাট, ঝালকাঠি, কিশোরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, মাদারীপুর, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, নেত্রকোনা, নীলফামারী, নোয়াখালী, নরসিংদী, পঞ্চগড়, রাজবাড়ী, রংপুর, শরীয়তপুর, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের নতুন নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জামুকার মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম বলেন, নতুন তালিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি ও বিভাগীয় কমিটির যাচাই-বাছাই শেষে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সভায় তালিকা অনুমোদন করা হয়। দেড় লাখের বেশি আবেদন থেকে তিন ধাপে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে এ গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

হঠাৎ এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করায় হতাশা প্রকাশ করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘এত নতুন মুক্তিযোদ্ধা এল কোথা থেকে? আর এত লোকের নাম প্রকাশেরই–বা দরকার কী! এখন মহামারির সময় তো মানুষ ধরতেও পারবে না কোনো অমুক্তিযোদ্ধা ঢুকে গেল কি না।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, একজন সাংসদ বা একজন ইউএনও কখনো যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের সঙ্গে নিতে হবে, যাঁরা যাচাই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি কীভাবে তাঁরা তথ্য যাচাই করেন। এভাবে জামুকার বৈঠকখানায় মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা যায় না। এতে শুধু এই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধই হবে।’

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007335901260376