বিদেশি ভাষায় দেশি শিক্ষা প্রসঙ্গে - Dainikshiksha

বিদেশি ভাষায় দেশি শিক্ষা প্রসঙ্গে

আবুল কাসেম ফজলুল হক |

‘সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষা’ বিস্তার লাভ করছে। ইংলিশ ভার্সন ক্রমপ্রসারমান। বাংলা মাধ্যম কি ভালো চলছে? ইংলিশ ভার্সন কি বেশি ভালো চলছে? কেবল ইংলিশ ভার্সনে পড়ানো হয়, বাংলা মাধ্যম নেই— এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিন দিন বাড়ছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন দেখে এটা বোঝা যায়। এ সম্পর্কিত তথ্যাদি সহজলভ্য নয়। হয়তো সেজন্যই এ নিয়ে সাংবাদিকদের সক্রিয়তা চোখে পড়ে না। ফেসবুকেও ইংলিশ ভার্সন নিয়ে লেখালেখি, তর্কবিতর্ক, পক্ষ-প্রতিপক্ষ নেই। টক শোতে কিংবা উপসম্পাদকীয়তেও বিষয়টি আলোচিত হয় না। এ বিষয়ের আলোচনা Status quo রক্ষার প্রতিকূল। সবাই তো Status quo রক্ষার সম্পূর্ণ অনুকূলে থেকে চিন্তা করেন— মত প্রকাশ করেন। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কেবল ইংলিশ ভার্সন নিয়ে চলছে এমন কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ২০০৯-২০১৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বাধিক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ-৫ সহ পাসের হার ১০০%। ২০০৯-২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় সর্বাধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ-৫ সহ পাসের হার ১০০%। ২০১০-২০১৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ-৫ সহ পাসের হার ১০০%। ইংলিশ ভার্সনের অবস্থা সব স্কুলে কি এক রকম?

আমার অনুমান করতে ইচ্ছা করে যে, পরীক্ষার ফল বিচারে বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংলিশ ভার্সন ভালো চলছে। শিক্ষা যে ভালো হচ্ছে তা আমার মনে হয় না। ইংলিশ ভার্সন নিয়ে যারা চলছে, তারা সচেতন জাগ্রত। বাংলা মাধ্যম নিয়ে যারা আছে ,তাদের মধ্যে সচেতনতা নেই, ভবিষ্যত্-ভাবনা নেই, দূরদর্শিতা নেই— তারা ঘুমন্ত। সরকার ও শাসক শ্রেণির লোকেরা অবশ্যই ইংলিশ ভার্সনের প্রতি বেশি যত্নবান। গত প্রায় চার দশক ধরে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার ব্যাপারে সরকারের ও এনজিও মহলের লোকদের তত্পরতা খুব বেশি দেখা যায়। খবরে প্রকাশ, সরকার ক্ষুদ্র  জনগোষ্ঠীসমূহের পাঁচটি বিলীয়মান ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের এনজিও মহল বুঝতে পারে না যে, বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করা যাবে না। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহও নিজেদের মাতৃভাষাকে উন্নত করার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী নয়। বাহ্য প্রচেষ্টা দ্বারা কি তাদের মাতৃভাষা বিকাশশীল হচ্ছে? ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে মানবজাতির মূল ধারায় আসতে পারে, উন্নতি করতে পারে, তার জন্য বৃহত্ জনগোষ্ঠীসমূহের পক্ষ থেকে তাদের সহায়তা করাই কি তাদের জন্য এবং গোটা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর নয়? যুক্তরাষ্ট্রের, কানাডার এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের যেভাবে রাখা হয়েছে, তা কি দুনিয়াব্যাপী আদিবাসীদের প্রতি বৃহত্ জনগোষ্ঠীসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত? আদিবাসীদের নিজেদের ভাষা আছে, কিন্তু সেসব ভাষার বিকাশ নেই। পৃথিবীর কোথাও তারা কেবল নিজেদের ভাষা নিয়ে চলে না। তারা পার্শ্ববর্তী বৃহত্ জনগোষ্ঠীর ভাষা শেখে এবং সে ভাষা নিয়ে চলে। কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বা নৃগোষ্ঠীরই স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র নেই। তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকতে হয়। এটাও তাদের নিজেদের ভাষার বিকাশহীনতার কারণ। তারা কি নিজেদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?

বাংলাদেশ পাঁচটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার জন্য তাদের ভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে বটে, তবে ওইসব জনগোষ্ঠীর লোকরা তাদের ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদানেই আগ্রহী। যারা সচ্ছল ধনী তারা ইংরেজিতেও আগ্রহী। যারা একেবারে গরিব, তাদের মনোভাব ভিন্ন হতে পারে। তবে তাদেরকে তাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে কি তাদের ভবিষ্যত্ উজ্জ্বল করা যাবে? বাংলাদেশের অবশিষ্ট চল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য দরকার। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে ঐক্য গড়ে উঠছে না— নানা রকম অনৈক্য বিকশিত করা হচ্ছে। দরিদ্র বাঙালি, ধনী বাঙালি, মধ্যবিত্ত বাঙালি, গ্রামীণ বাঙালি, শহুরে বাঙালি, শিক্ষিত বাঙালি, শিক্ষাবঞ্চিত বাঙালি, সাঁওতাল বাঙালি, গারো বাঙালি, চাকমা বাঙালি, মারমা বাঙালি, রাখাইন বাঙালি ইত্যাদি আছে। এই বহুত্বমূলক বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। যে বৈচিত্র্য বাস্তবে বিরাজ করছে। অবশ্যই কার্যক্ষেত্রে তাকে বিবেচনায় ধরতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে সরকারকে ক্ষুদ্র বৃহত্ এই সকল জনগোষ্ঠীর লোকদের ন্যায় স্বার্থের প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বহুত্বমূলক ঐক্যের কিংবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রশ্নেও যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। ঐক্য বাদ দিয়ে কেবল বহুত্ব— বহুত্ববাদ অকল্যাণকর। বাস্তবতা বিবেচনা করে জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশ্বায়নের নামে যে কাণ্ডকারখানা চালানো হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সম্পূরক হবে আন্ত রাষ্ট্রিক কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রের, জাতির, জাতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকবে, আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ককে সহযোগিতামূলক করার জন্য আন্তর্জাতিকতাবাদ ও আন্তঃরাষ্ট্রিক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান জাতিসংঘ দিয়ে হচ্ছে না। জাতিসংঘকে উন্নত করতে হবে অথবা জাতিসংঘের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে উন্নততর নতুন আন্তঃরাষ্ট্রিক কোনো কর্তৃপক্ষকে। জাতীয়তাবাদের সম্পূরক রূপ দিতে হবে আন্তর্জাতিকবাদকে। বুঝতে হবে যে, জাতীয়তাবাদ আর উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও নািসবাদ এক নয়।

সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার অনুসারী বিশিষ্ট নাগরিকেরা, এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশানের কর্তাব্যক্তিরা উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও  সাম্রাজ্যবাদকে এক করে প্রচার কার্য চালায়। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ অনুসারী এনজিওপন্থি বামপন্থিরাও তাই করেন। তারা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন। তারা চলমান বিশ্বায়নবাদের অনুসারী। বিশ্বায়নবাদ তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর রূপ। বাস্তবে দখা যায়, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সমন্বিত রূপ হচ্ছে চলমান বিশ্বায়নবাদ। বিশ্ব ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে। জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রকে মর্যাদা দিতে হবে। জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে অবলম্বন করে বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেও রাষ্ট্রের অন্তর্গত জনগণের সকল জনগোষ্ঠীর কল্যাণে পুনর্গঠিত করতে হবে। তাতে Status quo তে যে পরিবর্তন দরকার, পর্যায়ক্রমে তা সাধন করতে হবে। Status quo রক্ষা  করে চললে যেমন চলছে, তেমনই চলবে। অবস্থা অল্পই উন্নত করা যাবে।

বাংলাদেশে সরকারি নীতি অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে দেশীয় বিষয়াদি শিক্ষা দান প্রসঙ্গে সরকার পরিচালিত ইংলিশ ভার্সন নিয়ে কথা তুলেছিলাম। যারা এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তারা কি বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে রক্ষা করতে, বিকশিত করতে ইচ্ছুক। তারা তো তাদের ছেলে-মেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিক করে চলছেন। রাষ্ট্র হিসেবে তারা বাংলাদেশকে কি viable মনে করেন?

তাদের নেতৃত্বে—তাদের পরিচালনায়—বাংলাদেশ কি রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠবে? ইংরেজি ভাষায় দেশি বিষয়াদি শিক্ষাদানের জন্য ইংলিশ ভার্সন চালাবার সময় সরকার কি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার বিবেচনা আদৌ করে? ব্যক্তি, জাতি, রাষ্ট্র ও চলমান বিশ্বায়ন নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-ভাবনা কী? ইংরেজি ভাষায় দেশীয় বিষয়াদি শিক্ষাদানের চেয়ে ইংরেজি ভাষায় ইংরেজদের বিষয়াদি শিক্ষাদানই কি বেশি যুক্তিসঙ্গত নয়? কারণ ছেলে-মেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিক করার জন্য সেটাই অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে। বাংলাদেশ কী ‘কাজে লাগবে’? ব্রিটিশ সরকার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের দ্বারা সে ব্যবস্থা বাংলাদেশে ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭-এ ইংরেজ বিদায় নিয়েছে বটে, তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে এ লেভেল, ও লেভেল পর্যায়ে শিক্ষাদানের কাজ বাংলাদেশে ভালোভাবেই বহাল রেখেছে। সেগুলোতে পড়ার খরচ বেশি। ইংরেজি মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রও এদেশে বিদ্যালয় চালাচ্ছে। ইংরেজদের কমনওয়েলথ আছে, তাদের স্কলারশিপ আছে, আছে শিক্ষা ও গবেষণার সাম্রাজ্যবাদী আরো নানা কার্যক্রম।

বলা কি যাবে যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে, উপনিবেশবাদ ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নেই? ইংলিশ ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, আলিয়া ধারার মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, এনজিওদের দ্বারা পরিচালিত নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বাংলাদেশে আছে। সরকার মিলেনিয়াম ডেভেলেপমেন্ট গোলস বাস্তবায়িত করেছে। পঞ্চম শ্রেণিতে, অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তন করেছে, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বানাবার জন্য সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। শিক্ষার্থীদের জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, প্রশ্ন ফাঁস দমনে কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছে, আরো কত কি আয়োজন ও বিপুল প্রচারকার্য চালাচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণিতে ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে কোচিং সেন্টার ও গাইড বুকের ব্যবসায়ে স্বর্ণযুগ দেখা দিয়েছে। শিক্ষার উন্নতি নিয়ে আনন্দ উল্লাসের অন্ত নেই। এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত্ কী? বাংলাদেশে কয়জন ইংরেজিভাষী হবে? কয়জন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায় নাগরিক হতে যাবে? বাকিরা কেমন থাকবে? বাংলাভাষী, চাকমাভাষী, গারোভাষী, সাঁওতালভাষী, অবশিষ্ট বাংলাদেশিদের কী হবে? তারা আলাদা আলাদা ভাষা নিয়ে থাকবে?

শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল ভাষার প্রশ্নই নয়, শিক্ষার বিষয়, সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক নিয়েও প্রশ্ন আছে। শিশুদের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার পরীক্ষামুখি যে সৃজনশীল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের কোন্ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? ষোলকোটি মানুষের ভবিষ্যত্ কী? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ কী। বাঙালি, চাকমা, গারো সাঁওতালদের ভবিষ্যত্ কী? পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী নীতির অন্ধ অনুসারী হয়ে আমাদের কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ আছে কি?

ভাষার প্রশ্নে ভাববার আছে অনেক কিছু। এতে কি কোনো সন্দেহ আছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনার বাস্তবসম্মত যুক্তিসঙ্গত বিকাশ ঘটিয়ে আমরা চলছি না? এতে কি কোনো সন্দেহ আছে যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বাস্তবসম্মত যৌক্তিক বিকাশ ঘটিয়ে আমরা চলছি না? জাতীয় পর্যায়ে আমাদের আত্মসমালোচনা ও আত্মোত্কর্ষ দরকার।

গোটা ঐতিহাসিক কালব্যাপী সব জাতির মধ্যেই দেখা যায়, মানুষের জীবনের সঙ্গে ভাষার কিংবা ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত জীবনও সেখানে উন্নত। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি বা জাতি উন্নতি করতে পারে না। আরও দেখা যায় ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সংগীত শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে চিন্তা ও ভাষা। সব মানবীয় কর্মকাণ্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন। জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির সঙ্গেও ভাষার উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল। ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায় তথ্যসন্ধান ও বিচার বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের উন্নতির অবিচ্ছেদ্যতা সম্পর্কে ধারণা গভীর ও ব্যাপক হয়।

আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা না থাকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও টিকবে না।

মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত করার এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। গোটা ইতিহাস জুড়ে মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে-ওঠা প্রাণী। পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার সঙ্গে সামাজিক বিরোধের মধ্য দিয়ে তারা বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার এই অগ্রগতি চলমান। আদিতে মানুষের ভাষা ছিল না, ভাষা মানুষই সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের জৈবিক সামর্থ্যের বলে, যৌথ জীবনযাত্রার ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেছে, এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তারা তাদের ভাষাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। ব্যক্তিগত ও যৌথ জীবন প্রয়াসে মানুষের চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি এক সঙ্গে কাজ করেছে ভাষা সৃষ্টিতে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি, সংস্কৃত, হিব্রু, লাতিন, বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি প্রভৃতি ভাষার ইতিহাস সন্ধান করলে এটা বোঝা যায়।

দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দু শ ভাষা দুনিয়ায় আছে। এসব ভাষা বিকাশশীল। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলাভাষার স্থান এখনো উপরের দিকেই আছে। বাংলাদেশের ভূভাগে জাতির অবস্থা এবং রাষ্ট্রের অবস্থা উন্নত করা গেলে বাংলাভাষাও উন্নত হবে। অপরদিক থেকে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের ভূভাগে জাতির অবস্থা ও রাষ্ট্রের অবস্থা উন্নত করতে হলে বাংলাভাষাকে উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশের বাঙালি জাতিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তুল্য গণ্য করলে, বাংলাভাষাকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের বিলীয়মান ভাষাগুলোর মতো বিলীয়মান ভাষা গণ্য করলে বাংলাদেশের বাঙালিদের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। বাংলাদেশে আমরা যদি বাংলাভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করি এবং বাংলাভাষার উন্নতি সাধন করি জাতি হিসেবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নীতি নিয়ে জাতি গঠন করি, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলি, তাহলে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজুরাম, মনিপুর, মেঘালয়, আসাম প্রভৃতি অঞ্চলের জনসাধারণও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি এবং বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। ইংলিশ ভার্সনের ব্যাপারটিকে নতুনভাবে বিচার বিবেচনা করে দেখা দরকার। আমরা ইংরেজি শিখতে চাই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে গ্রেকো-রোমান ইউরো আমেরিকান প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যকে জানবার জন্য। তার জন্য পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদী, ফ্যাসিবাদী, নািসবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করে চলতে হবে।

লেখক :চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059850215911865