বিলম্বিত ‘মোদের গরব মোদের ভাষা’র প্রতিষ্ঠা - দৈনিকশিক্ষা

বিলম্বিত ‘মোদের গরব মোদের ভাষা’র প্রতিষ্ঠা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একদা (এমনকি এখনো) বৈদিক ভাষার বিষম সম্মান ছিল। মানুষের বিশ্বাস, মুনিঋষিরা যে বৈদিক শ্লোক উচ্চারণ করতেন, তা স্বর্গীয় এবং স্রষ্টার ভাষা। শুধু বৈদিক নয়, হিব্রু ভাষাও ইহুদিদের কাছে পবিত্র বলে এত বিবর্তনের পরেও তাদের কাছে সে ভাষার কদর আছে। ইসলাম ধর্মের চাবিকাঠি আরবি ভাষা। বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আজকের দিনে কোথাও কোথাও বৈদিক ভাষার অলৌকিক শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, এ ভাষায় পঠন-পাঠন নাকি সর্বরোগের জন্য ধন্বন্তরি। হায় ক্ষমতা মদমত্ততা! শক্তি প্রয়োগে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশলকে এখন ধর্মের আবেগ দিয়ে বাঁধ দিয়ে রাখতে চায়। যদিও এটি পুরনো কৌশল।

সবার জানা, ভাষা নদীপ্রবাহের মতো। উৎস থেকে প্রবাহ শেষ হয়ে গেলে নদী যেমন ‘মরুপথে’ ধারা হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্যবহারকারী না থাকলে ভাষা টিকে থাকে না—কেতাবি হয়ে যায়। কোনো কোনো ভাষা রূপান্তর হতে হতে এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে ভাষাচিন্তাবিদদের গবেষণায় নিয়োজিত হয়ে আদি রূপের সন্ধান করতে হয়। আমাদের মাতৃভাষার আগমন এবং পদচারণের ওপর একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেছে কিছু মতানৈক্যসহ। আমরা সেদিকে যাব না। আমরা মহান একুশের পথ ধরে আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্বের পথে জারিজুরির সন্ধান করব।

সাহিত্যের পাতায় বাংলা ভাষা যখন হাঁটি-হাঁটি-পা-পা তখন থেকেই এর ওপর উত্পীড়ন শুরু। প্রাণের ভাষা রক্ষা করার জন্য বাংলা ভাষায় আদি পদকাররা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। স্থাবর-অস্থাবর সব ছেড়ে গেলেও হৃদয়ের স্বাক্ষর পুঁথিগুলো সঙ্গে নিতে ভোলেননি। আমরা তার সন্ধান পেয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় সাহায্য পেয়েছি।

আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার জন্য একুশের প্রাণ উৎসর্গ ধর্মীয় আবেগ থেকে আসেনি। এ আন্দোলন ঐহজাগতিক ও মানবিক। বাংলা ভাষার ঐশী বাণী লিপিবদ্ধ ছিল না, ছিল না সামন্তপ্রভু বা গোত্রপ্রধানদের জীবনী। অথচ তা রক্ষার যে আগুন জ্বলেছিল ঢাকার রাজপথে তা পূর্ববাংলার ‘সবখানে’ ছড়িয়ে যায়।

আদিতে ভাষা ছিল অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘তখন ছিল নিত্য অনিশ্চয়,/ইহকালের পরকালের হাজার রকম ভয়/’ কালের পরিক্রমায় ভাষা সামগ্রিক জীবনের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়। জ্ঞান আহরণ, সামাজিক বিধি-নিষেধ ভাষাতেই অন্বিত। লেখা বাহুল্য, তা অবশ্যই মাতৃভাষা। দেবভাষা বা আসমানি ভাষা যে অভিধায় মানুষ তার মূল্যায়ন করুক না কেন, আসলে তা সমকালের মাতৃভাষা। বলা হয়েছে, মাতৃভাষা আরবিতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে সবার বোধগম্যের জন্য।

 যেকোনো ভাষা মানুষ জন্মেই আয়ত্ত করেনি। তা আত্মস্থ করা দীর্ঘ অনুশীলনের ফল। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সব জাতি ও সভ্যতার আদি রূপ নানাভাবে ভাষার মাধ্যমে উত্কীর্ণ থাকে। বেশির ভাগই হয়তো হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য : সম্রাট অশোক ভাষার মাধ্যমে ‘পাহাড়কে কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন।’ সেসব কথার অর্থ ইউরোপের পণ্ডিতরা আমাদের বোঝার সক্ষমতা এনে দিয়েছেন।

জ্ঞানার্জনের মাধ্যম মাতৃভাষা হবে তা নিয়ে বেশি বিতর্ক থাকার কথা নয়। আমরা যারা শিকড় ভুলে গেছি, উপরি কাঠামো নিয়ে বিভ্রান্ত, তারা মাতৃভাষার গুরুত্ব খেলো করে দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশি কুকুরের প্রতি আসক্ত। রামনিধি গুপ্তের ‘বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা’ অনুসরণে ঈশ্বরগুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন—‘বৃদ্ধি কর মাতৃভাষা,/পুরাও তাহার আশা,/ দেশে কর বিদ্যা বিতরণ।’ তারও আগে সপ্তদশ শতকে কবি আব্দুল হাকিম মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষাবিদ্বেষীদের কঠিন ভাষায় বলেছিলেন, যারা বাংলাকে হিংসা করে ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি।’

শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি অর্থাৎ জীবনাচারের সর্বত্র মাতৃভাষা অপরিহার্য। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যাসাগর, অক্ষয়দত্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে কম সোচ্চার ছিলেন না। আমরা সেসব আমলে নিইনি। অপর ভাষা শেখা অন্যায় নয়; তাই বলে শক্তিশালী বাংলা ভাষাকে অগ্রাহ্য করে! এ যে পরের ভাষায় রং মেখে সঙ সাজা! ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি জজবা আবার বাংলা ভাষার পিঠে ধর্মের লেবাস পরাবার চেষ্টা হয়েছে। এখনো চলছে।

নতুন দেশের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে দেশভাগের জল্পনা-কল্পনার সময় থেকে বিতর্ক শুরু। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যার চূড়ান্ত রূপ নিল। আমরা সেই থেকে দিবসটি উদ্যাপন করে আসছি। কে জানে এতে আন্তরিকতার পরিমাণ বেশি, না লোক-দেখানো। দুর্মুখেরা বলে ওসব কিছুই নয়, নিছক লোক-হাসানো!

দেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু জাতির জীবনের সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি যে পরস্পরের পরিপূরক। কিছু পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত আমলা আর কিছু মাতৃভাষা তুচ্ছজ্ঞানকারী ব্যক্তির অনীহায় তাত্ক্ষণিকভাবে তা কার্যকর করা যায়নি। তাদের বড় অজুহাত ছিল ইংরেজির বাংলা প্রতিশব্দের অভাব।

পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির পর আন্তর্জাতিকতার দোহায় দিয়ে নতুন উদ্যমে ইংরেজির সমারোহ ঘটল। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হলো। উনিশ শতকে ছিটেফোঁটা ইংরেজি জানারা যেমন শাসকদের আশীর্বাদ লাভের জন্য উদ্বাহ হয়েছিল, তেমনি আততায়ী সরকারের সময় বাংলা ভোলাবার জন্য প্রথমে ইংরেজির মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে ইংরেজি জানাদের বেশি টাকা বেতন দিয়ে, প্রকারান্তরে অন্যদের ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট করা শুরু করল। সেই ভাবনাকে জোরদার করার জন্য ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠা হওয়া শুরু হলো। দুঃখের বিষয়, তারা ইংরেজি তো শিখলই না, পক্ষান্তরে মাতৃভাষাকে ভুলের পথে নিক্ষিপ্ত করল। অবস্থা এমনি দাঁড়াল যে মাস্টার্স পাস করা অনেকের বাংলা ভাষায় গরিমা দেখে যেন ভূতেও ভিরমি খায়।

সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে কিছু উচ্চাভিলাষীকে পদারোহী করা ছাড়া ‘মোদের গরব মোদের আশা’, বাংলা ভাষা সসম্মানে স্থান পেল কই?

লেখক : গোলাম কবির, সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060060024261475