ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সামনে এখন অপেক্ষমাণ ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী। কাদায় আটকানো হাতি যেমন ডাঙায় ওঠার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে, একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে এই বিশাল দুস্তর বৈতরণী পার হতে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয় প্রাণপণ। এ পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করে তার স্বপ্নের মতো। যে স্বপ্নটি সে বুকের মধ্যে অনেক বছর ধরে লালন করে আসছে। বৃহস্পতিবার (০৫ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকার নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
এক্ষেত্রে তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে পারে জানার আগ্রহ, অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং নিষ্ঠা। সেই সঙ্গে চাই একাগ্রতা। চাই আত্মস্থ, মুখস্থ নয়। মানুষ যখন তার লক্ষ্যের পেছনে, স্বপ্নের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে বেড়ায় কেবল তখনই সাফল্য এসে ধরা দেয়— এই কথাটি বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের সেই বিখ্যাত কথাটি- ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ মানুষের বাস্তবতা কত গভীরভাবে অনুধাবন করলে এই রকম একটি গভীরতম কথা বলা যায়।
ভর্তিযুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চেয়ে কি কোন অংশে কম? লাখ লাখ শিক্ষার্থী যোদ্ধার সঙ্গে মেধা নামক অস্ত্রটি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় একজন শিক্ষার্থী যোদ্ধাকে। এই যুদ্ধভূমিতে নিজের জায়গাটি তৈরি করে নিতে হলে অবশ্যই পড়াশোনার বিকল্প নেই। হাতের কাছে সিলেবাস অনুযায়ী যা থাকবে, সব পড়ে ফেলতে হবে। শুধু পড়লেই হবে না, মনে রাখতে হবে, কতটা পড়েছ, বিষয় নয়: কতখানি মনে রাখতে পেরেছ সেটিই হলো বিষয়। মনে রাখার জন্য কৌশল অবলম্বন করে পড়া আবশ্যক।
প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষা এলে সেই দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের তীব্র সংগ্রামের কথা। একজন শিক্ষার্থীকে ঢাকা থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল, রবিশাল থেকে ময়মনসিংহ। এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে ছুটতে হয় সমগ্র বাংলাদেশে। আরো একটি সমস্যা তো আছেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একই দিনে বা পর পর অনুষ্ঠিত হয়।
এ বছরও মেডিক্যাল এবং বুয়েটের পরীক্ষার সময়সূচি যথারীতি ৪ এবং ৫ অক্টোবর। ফলে শিক্ষার্থীদের বানের জলে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাই অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা অবশ্যকরণীয়। নয়তো যেভাবে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে, তাতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দুর্দশা, দুরবস্থা, দুঃসহ লড়াই এবং ভোগান্তি আরো চরম থেকে চরম আকার ধারণ করবে।
শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। মেডিক্যাল কলেজে একদিনে একটি প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। সম্প্রীতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ার আওতায় এসেছে। এখন সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সব প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই দিনে একটি অভিন্ন প্রশ্ন পদ্ধতি পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি অভিন্ন পরীক্ষার আওতায় আনার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই দাবি বাস্তবায়নে বারবার প্রধানত বাধা ও অনিচ্ছা পোষণ করে আসছে বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
মূলত শিক্ষকদের গোষ্ঠীস্বার্থ উচ্চমূল্যে ফরম বিক্রিসহ ভর্তি পরীক্ষায় নানারকম ডিউটি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও অন্যান্য কাজ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ রোজগার করে থাকেন। ফলে যে চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩-এর আইন বা অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলছে তারা অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির সিদ্ধান্তে একদমই আগ্রহী না। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে ৭৩ সালের আইন ও অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতিতে না যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যাগুলোর নিজস্ব স্বকীয়তা এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আলাদা চিন্তাভাবনা আছে।
তাই এই চরম বাস্তবিক সমস্যা লাঘবের জন্য দরকার হলে, শুধু এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হউক। বাকিগুলো যেগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমরা জানি, সেগুলোকে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে একটি আইনের মাধ্যমে নিয়ে এনে অতিদ্রুত সময়ে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান করা হোক। নয়তো আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দম বন্ধ হয়ে ঝরে যাবে।
সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এইটুকু বলব, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ শিক্ষার্থীরা, শিক্ষার্থীদের প্রাণ বিশ্ববিদ্যালয় বা নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছু পরিবর্তনশীল। প্রতিটি স্তরে মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন আসে। একবার সফল হওয়া মানেই জীবন অসাধারণ আলোকিত নয়, আবার একবার ব্যর্থতা মানেই জীবন অন্ধকারময় নিদারুণ সংকট নয়। সর্বদা সত্য ও সুন্দরের পথে হাঁটলে জীবনে আলো আসবেই। তাই নিজের সুস্থতার প্রতি সর্বাগ্রে মনোযোগী হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : অরিত্র দাস,শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়