বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার অংশ হিসেবে মাদক পরীক্ষা বা ‘ডোপ টেস্ট’ চালুর প্রস্তাব করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বর্তমানে মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ‘ডোপ টেস্ট’ করা হচ্ছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি শেষ ১০ দিনে কোনো মাদক গ্রহণ করেছেন কি না, তা ধরা পড়বে। এজন্য ছয়টি পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি টেস্টের জন্য খরচ হয় ৯০০ টাকা। এসব পরীক্ষায় গাঁজা, হেরোইন, ইনজেক্টেবল ড্রাগ, ফেনসিডিল ও ইথাইল অ্যালকোহল (মদ)-এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়া লালা পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ সাত দিন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ দুই মাস, চুল পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ ১২ মাস এবং স্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেউ মাদক গ্রহণ করলেও তা পরীক্ষায় ধরা পড়বে। এ সব পরীক্ষার পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে কার্যকর করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন।
বর্তমানে দেশে ডোপ টেস্টের নামে আসলে মূত্র পরীক্ষাই করা হচ্ছে। এমনিতেই মল-মূত্র নিয়ে মানুষের বিড়ম্বনার কোনো শেষ নেই। এখন নতুন করে ‘মূত্র’ নিয়ে শুরু হয়েছে টানা-হেঁচড়া! বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
পেশাব, পেচ্ছাব, প্রসাব, প্রস াব, মূত্র, মুত, হিসু ও পিসু। জিনিস একই, হরেক রকম নাম! আমাদের জীবনের অনিবার্য এক অনুষঙ্গ। মেয়েদের ঋতুমতি হওয়া বা যৌনতা সম্পর্কে আমাদের সমাজে যেমন একটা রাখ-ঢাক ব্যাপার আছে, হাগু-মুতুর ব্যাপারেও একধরনের ট্যাবু বা সংস্কার কাজ করে। আমরা মুত বা হিসু নিয়ে কথা বলতে কেমন যেন একটু শরম পাই। স্কুলে যখন পড়তাম তখন ক্লাস চলাকালে ‘চাপ’ এলে বলতাম, স্যার একটু বাইরে যাব। স্যার বুঝে নিতেন, এই ‘বাইরে’ মানে কী! অথবা বলতাম বাথরুমে যাব বা ‘বাথরুম পেয়েছে’!
ছোটোকালে আমরা গোসলখানা, শৌচাগার সবকিছুকেই বাথরুম বলতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম, ‘বাথরুমগুলো’ সব কেমন করে যেন ‘টয়লেট’ হয়ে গেছে! যাহোক, আমাদের ‘বাথরুম পাওয়া’, বা ‘টয়লেট পাওয়া’ও ভারি আজব ব্যাপার।
একটা মানুষের হিসু পেতে পারে। ‘বড়ো চাপ’ও আসতে পারে, তাই বলে একটা ‘বাথরুম‘ বা ‘টয়লেট’ কীভাবে ‘পায়’, সেটা ভাবলে হাসি আসে! আমরা ‘ভদ্রলোকেরা’ ভাষার ওপরও কতটা জবরদস্তি করি! চাষা-ভুষোরা কিন্তু দিব্যি বলে, একটু ‘মুতে আসি’, কিংবা ‘হাগবো’। তাতে তাদের সম্মান যায় না। কিন্তু সমাজে তথাকথিত ভদ্রলোকদের অনেক কিছুতেই সম্মান যায়। এই সম্মান বাঁচাতে তারা ‘টয়লেট পাওয়ার মতো অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করেন। অথবা এসব কথা ইংরেজিতে বলেন! যেন ইংরেজিতে বললেই ওটার মর্যাদা রক্ষা পায়!
যা কিছু প্রাকৃতিক, অনিবার্য সেগুলো ঢেকে রাখা কিংবা আকার-ইঙ্গিতে অথবা ইংরেজিতে বলার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য আছে তা ঈশ্বর জানেন! আর জানেন সেই সব ‘ভদ্রলোকেরা’!
যা হোক, আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় বা ইসু হচ্ছে হিসু। মানুষের যেমন কান্না পায়, হাসি পায়, ক্ষুধা পায়, ঘুম পায়, ঠিক তেমনি হিসুও পায়। আমরা যে পরিমাণ পানি পান করি, তার মধ্য থেকে যেটুকু বর্জ্য, তা হিসু হয়ে বের হয়ে যায়। হিসু যদি না পায়, আমাদের শরীরের ভেতরের দূষিত পানি যদি বের হয়ে না যায়, তাহলে আমরা বাঁচতে পারব না। নিয়মিত হিসু না হলে আমাদের মৃত্যু অবধারিত। হিসু সেই দিক থেকে খুবই প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। অথচ এই জিনিসটিকে নিয়েই আমাদের কত নাটক। কত অভিনয়!
ছোটবেলায় আমাদের হিসু আসে ক্ষণে ক্ষণে। শ্রাবণের বৃষ্টির মতো। আনলিমিটেড। কোনো আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই যখন-তখন বের হয়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হুঁশ-জ্ঞান বাড়ে। আমরা নির্দিষ্ট স্থানে হিসু করতে শিখি। কিন্তু অনেকে অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত বিছানায় হিসু করে চরম লজ্জা ও অপমানের ভাগীদার হন। এটা অবশ্য একটা রোগ।
হিসু সবাই করেন। এর কোনো উচ্চ-নিচ-ধনী-দরিদ্র নারী-পুরুষ, আস্তিক-নাস্তিক ভাগ নেই। প্রাচীন মানুষরা যেমন করেছেন, বর্তমান মানুষরা করছেন, নিশ্চয়ই অনন্ত আগামীর মানুষরাও তা করবেন। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আবিষ্কৃত হবে বলে মনে হয় না। হয়তো ‘ডায়েপার’ জাতীয় জিনিসের আরো উন্নত সংস্করণ আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু হিসু নিঃসরণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না!
তবে আমরা সব সময় স্বেচ্ছায় নিজ গরজে হিসু করি না। অনেকে আছেন ভয়ে হিসু করে দেন। অনেকে মারের চোটেও হিসু করেন। অনেকে দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখতে না পেরে কাপড়ে-চোপড়ে হিসু করেন। হিসু নিয়ে প্রত্যেকের জীবনেই কোনো না কোনো ‘গোপন’ অভিজ্ঞতা আছে। ছোটোরা যেমন যেখানে- সেখানে কাপড়ে-চোপড়ে, বিছানায় হিসু করে দেয়, বড়োরাও অধিক বার্ধক্যে পৌঁছলে এই কাজটি করেন। ছোটোরা কাজটি করে লজ্জিত হয় না, কিন্তু বড়োরা হন এবং এটা ঢেকে রাখতে অনেক ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ডোপ টেস্ট’-এর নামে মূত্র পরীক্ষার এই ব্যবস্থাটি খুবই ইনোভেটিভ একটি আইডিয়া হিসেবে অনেকের কাছে বিবেচিত হচ্ছে। তাদের মতে, ভালো, ভদ্র, রুচিবান, স্বাস্থ্যবান ও নেশাগ্রস্ত নয়, এমন টগবগে তরুণসমাজকে আগামীদিনের বাংলাদেশের নেতৃত্বে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এই উদ্যোগ অত্যন্ত চমকপ্রদ ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কিংবা বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচনে, স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে, শিক্ষক নিয়োগে, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি-বেসরকারি যে কোনো ক্ষেত্রেই এই মূত্র-পরীক্ষা মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
আরেক পক্ষের মন্তব্য: সুস্বাস্থ্যবান, মাদকমুক্ত, নীতি-আদর্শবান ব্যক্তিদের হাতে যদি দেশ চলে যায়, তাহলে বিরাট সংকট ও শূন্যতা সৃষ্টি হবে। কারণ, এখন সবখানে আসন দখল করে আছে নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত দূষিত রক্তের ব্যক্তিরা। মূত্রপরীক্ষা, রক্তপরীক্ষা করে যদি দূষিত রক্ত ও মূত্রের লোকজনকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে রাজনীতিতে রাতারাতি গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে! আমাদের সমাজ এই পরিস্থিতির জন্য আদৌ তৈরি নয়! তাদের সবচেয়ে বড়ো শঙ্কা হচ্ছে: সব ক্ষেত্রে যদি এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে মানুষের মধ্যে মূত্র-আতঙ্কও তৈরি হতে পারে!
আমাদের জীবনে অনেক বিষয় আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভট কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশ্লীল মনে হলেও তা বেঁচে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। মূত্র জিনিসটাও ঠিক তেমন। এ নিয়ে আলোচনা আর না বাড়িয়ে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় ফিরে যাই। আমরা অনেকেই এই আদি এবং অকৃত্রিম লেখাটা পড়েছি—‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে একশত টাকা জরিমানা।’ কিন্তু অনেক দুষ্ট বালক বাক্যটির মধ্যে একটা 'কমা'কে স্থান পরিবর্তন করে অন্য রকম মানে খাড়া করাতেন। তারা লিখতেন, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে একশত টাকা জরিমানা।’ এগুলো আসলে কিশোর কিংবা সৃজনশীল যুবকদের অবসরের বিনোদন। এই কাজটা আমরা অনেকেই করেছি ছেলেবেলায়। যেমন ‘পড়াইতে চাই’য়ের আগে আমরা একটা ‘থা’ লাগিয়ে দিতাম। তাতে লেখাটা দাঁড়াতো ‘থাপড়াইতে চাই!’ এভাবে লেখাকে পালটে দেওয়ার মাঝেও কিছুটা রঙ্গ-রস কিংবা মজা করার ব্যাপার আছে। আর জীবনটা মজা বা কৌতুক ছাড়া আর কি?
আমাদের সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে চললেও ‘এখানে প্রস াব করিবেন ন?’ এই লজ্জাজনক সাবধান বাণীটি এখনো প্রায়শই নজরে পড়ে? গ্রামাঞ্চলে তেমন না হলেও, শহরের এমন বিজ্ঞপ্তির ছড়াছড়ি? কিন্তু সাবধানবাণী থাক বা না থাক যত্রতত্র প্রাকৃতিক কর্ম সারার লোক শুধু এই শহরে বা দেশে নয় গোটা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে এবং মজার ব্যাপার হলো ঠিক যেখানে লেখা থাকে: এখানে প্রসছর করে ‘ভ্রাম্যমাণ ঝরনা’ স্থাপন করবে!
পরিশেষে মূত্র বিষয়ে একটা বহুল প্রচলিত কৌতুক। এক বাচ্চা রোগীকে চিকিত্সক মূত্র পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। নার্স বাচ্চাটিকে একটা টেস্টটিউব দিয়ে বললেন, যাও, টয়লেটে গিয়ে এটা ভর্তি করে আনো।
বাচ্চাটি কিছুক্ষণ পর হাসি মুখে টয়লেট থেকে বেরিয়ে নার্সকে খালি টেস্টটিউবটি দিয়ে বলল, এটার দরকার পড়েনি। ভেতরে বড়ো একটা কমোড আছে। সেখানেই জমা করে রেখে এসেছি!
চিররঞ্জন সরকার : রম্যরচয়িতা।