বিশ্ববিদ্যালয় হোক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয় হোক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষা ও গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে শিক্ষার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো হবে। এর সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে তার মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গির মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন তার শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করবেন তখন সেই জ্ঞানের পরিধি বইয়ের পাতার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না। বরং একজন শিক্ষক তার বাস্তব ও কাল্পনিক চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতরের ঘুমন্ত চিন্তাশক্তিকে বের করে আনবেন। এটি নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দার্শনিকতার প্রভাব থাকতে হবে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, দার্শনিক কানিংহাম বলেছেন, জীবনের প্রয়োজনে দর্শনের জন্ম হয়। চিন্তার মাঝে যিনি বেঁচে আছেন তিনি কোনো না কোনোভাবে দার্শনিক। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় জীবনের প্রয়োজনে শিক্ষার জন্ম হয়। সেই শিক্ষা যখন চিন্তার খোরাক জোগায় তখন তা হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা। যেমন একজন শিক্ষক উড়োজাহাজ কীভাবে আকাশে ওড়ে তা শিক্ষার্থীদের শেখানোর আগে এ বিষয়ে তাদের নিজেদের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি জেনে নেবেন। সেখান থেকে হয়তো বিভিন্ন ধারণা আসতে পারে। সেটা ভুল কিংবা শুদ্ধ, কাল্পনিক কিংবা বাস্তব যে কোনো ধরনের হতে পারে। সেটা যাই হোক, শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের ভেতরের চিন্তাকে চর্চা করার সুযোগ পাবে। তাদের কাল্পনিক কিংবা ভুল ধারণা থেকে নতুন নতুন অনেক ধারণা বের হয়ে আসতে পারে। খুব একটা সাদামাটা ধারণা থেকে নতুন নতুন ধারণা মানুষের চিন্তার জগতে জায়গা করে নিতে পারে। এক্ষেত্রে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই সূত্র বলছে ‘দুটি বস্তু একে অপরকে সর্বদা আকর্ষণ করে।’ এমন একটা সহজ-সরল থিওরির ওপর ভিত্তি করে মানুষ আজ পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে বসবাসের চিন্তা করছে। কাজেই বোঝা যায়, কোনো চিন্তাশক্তির ফলাফল ফেলে দেবার মতো নয়। ক্রমাগত কল্পনা কিংবা ভুলকে শুধরে নিতে নিতে একসময় সেখান থেকে বিস্ময়কর বিশুদ্ধ চিন্তার জন্ম হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এমন করেই সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোভাব জানার পর শিক্ষক এই মনোভাবগুলোকে বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে সহজভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক নিয়ে এটাকে একটা গ্রহণযোগ্য জায়গায় নিয়ে আসবেন। উদাহরণ হিসেবে উড়োজাহাজের ওড়ার সঙ্গে পাখির ওড়াকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরবেন। এখান থেকেও অনেক নতুন নতুন ভাবনার জন্ম হতে পারে। সেই ভাবনাগুলো নিয়ে নতুন নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পড়ানোর সময় বই ব্যবহার না করে সমসাময়িক যে গবেষণা প্রবন্ধসমূহ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে জ্ঞানের আদান-প্রদানভিত্তিক আলোচনা করতে পারেন। সেই প্রবন্ধগুলোর ভেতর থেকে গবেষণার অনেক নতুন উপাদান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল ও নতুন চিন্তা সৃষ্টির উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে এই শিক্ষাদানের মধ্যে যেন আনন্দের উপাদান থাকে।

আমাদের দেশে গতানুগতিকভাবে ধারণা করা হয় যে, অনার্স লেভেলে শিক্ষার্থীদের গবেষণার কোনো সুযোগ নেই। এই সময় শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকবে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে এমন নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই একজন শিক্ষার্থী গবেষণানির্ভর শিক্ষাদানের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। এখন আমাদের সময় এসেছে গবেষণাসম্পৃক্ত উপাদানগুলো বিবেচনায় রেখে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামকে নতুনভাবে সাজানোর। আমাদের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, আমরা যাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা প্রথম সারির মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করছি তারা প্রকৃত অর্থে পেছনের সারির যারা রয়েছে তাদের চেয়ে মেধাবী কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স লেভেলের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই মুখস্থকেন্দ্রিক। এর ফলে যে শিক্ষার্থীরা না বুঝে মুখস্থ করে লিখছে তাদের আমরা বেশি করে মূল্যায়ন করলেও যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে বিষয়টি বুঝে লিখছে তাদের আমরা কম মূল্যায়ন করছি। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরে এসে আমরা প্রকৃত মেধাবীদের হারাচ্ছি। একই সঙ্গে মুখস্থ বিদ্যার জোরে মেধাহীনদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করছি। যেমন আমাদের সনাতন ধারণা বলছে, যারা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবে তাদেরকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিতে হবে। কিন্তু উচ্চস্তরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক না হওয়ায় আমরা প্রকৃত মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে আনতে পারছি না। এর ফলে আগামী প্রজন্ম প্রকৃত মেধাবী শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের মেধা ও চিন্তাশক্তি হারাতে পারে। যা আমাদের মেধা উন্নয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়নের যে আধুনিক ধারণা তাতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও মানবিক উন্নয়নের বিষয়টি এখনো পর্যন্ত বিবেচনায় আনা হয়নি। এটি আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা। কেবল শিক্ষাদান করে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীকে সীমাবদ্ধ রেখে তার মানবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে করে মানসিক ও মানবিক উন্নয়ন ঘটতে পারে তার বিভিন্ন সৃজনশীল কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মানবিক সম্পর্কের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে কোন প্রাচীর থাকলে চলবে না, তাদের পরস্পরের সম্পর্ক স্বচ্ছতা, সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে হতে হবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতিভাধর দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেবেন। জ্ঞানের আদান-প্রদান ও মনের আদান-প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে মেধা চর্চার তীর্থস্থান।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070521831512451