বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে: ড. জাফর ইকবাল - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে: ড. জাফর ইকবাল

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

আবার ভাঙা রেকর্ডটি বাজাই। এই ভাঙা রেকর্ড বাজানো ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি? (ভাঙা রেকর্ড বাজানোর অর্থ এক কথা বারবার বলা।

কথাটি কোথা থেকে এসেছে, এই যুগের ছেলে-মেয়েদের জানার কথা নয়। গ্রামোফোনের যুগে যে রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনা হতো, সেখানে খুব সূক্ষ্ম খাঁজ কাটা থাকত। ঘুরতে থাকা রেকর্ডের বাইরের প্রান্তে গ্রামোফোনের পিন লাগানো মাথাটি বসিয়ে দিলে সূক্ষ্ম খাঁজটি অনুসরণ করে গান বাজাতে বাজাতে সেটি রেকর্ডের ভেতরের প্রান্তে এসে শেষ হতো। রেকর্ড ভাঙা হলে বা সেখানে ফাটল থাকলে পিনটি একটি খাঁজে আটকে গিয়ে সেই খাঁজের অংশটুকুই বারবার বাজিয়ে যেত! তাই এক কথা বারবার বলা হলে আমরা বলি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া!)
আমি কোন ভাঙা রেকর্ড বাজানোর কথা বলছি, সেটি অনুমান করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন নয়, সেটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। দেশে এখন ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব বিশ্ববিদ্যালয় যদি ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি করে উইক এন্ড নিতে চায়, তাহলে ৪২টি উইক এন্ড দরকার। এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার মাঝখানে ৪২টি উইক এন্ড নেই! তার চেয়ে বড় কথা, দেশের প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক উইক এন্ডে পরীক্ষা শেষ করে না, তাদের বেশ কয়েকটি উইক এন্ড দরকার হয়। তারা তাদের পছন্দের উইক এন্ডগুলো বেছে নেওয়ার পর উচ্ছিষ্ট উইক এন্ডগুলো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাগাভাগি করে নেয়। শুধু তা-ই নয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে প্রতিটি বিভাগ আলাদা করে নিজের বিভাগের পরীক্ষা নেয়! সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হলে ছেলে-মেয়েদের গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে দিনের পর দিন থাকতে হয়।

তারা কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে, সেটি নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা দেখার সময়। এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া ছেলে-মেয়েদের কষ্ট পাওয়ার সময়। আর এই সময়টা আমার সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হওয়ার সময়।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার এই সময়টায় প্রতিবছরই নানা ধরনের অঘটন ঘটে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেগুলো লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একটা-দুইটা খবর বের হয়ে যায়, সেটি নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়, তারপর সবাই সব কিছু ভুলে যায়। এবার সর্বশেষ ঘটনা রাজশাহী বিশ্বদ্যািলয়ের চারুকলা বিভাগের দুটি প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজন নেই, একেবারে খুবই সাধারণ মানুষের চোখে পড়লেও তারা বলে দিতে পারত যে এ রকম প্রশ্ন ঠিক নয়। এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন, এক ধর্মকে বড় করে দেখিয়ে অন্য ধর্মকে খাটো করে দেখানোর প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্ন দুটি কারো চোখে পড়েনি। যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্ন কখনো একজন করেন না, বেশ কয়েকজনের একটা কমিটি প্রশ্নগুলো প্রস্তুত করে। কাজেই সেই কমিটির সব সদস্য উগ্র সাম্প্রদায়িক হবেন, তার সম্ভাবনা কম। বিষয়টি কমিটির কারো না কারো চোখে পড়ার কথা। কমিটির সদস্যদের কারোরই চোখে পড়েনি দেখে অনুমান করা যায়, সদস্যদের কেউই সম্ভবত প্রশ্নগুলো পড়ে দেখেননি। তাই কেউই হয়তো জানতেন না, সদস্যদের কোনো একজন এ রকম একটা প্রশ্ন ঢুকিয়ে রেখেছেন। ভর্তি পরীক্ষা মানেই হেলাফেলা, যেনতেনভাবে কিছু গাইড বই থেকে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে ফেলা। সেসব প্রশ্ন এত নিম্নমানের হয় যে মাঝেমধ্যে মনে হয় পরীক্ষা না নিয়ে লটারি করে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করার জন্য বেছে নিলেও হয়তো তাদের প্রতি বেশি সুবিচার করা হয়। হাইকোর্ট থেকে একবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়া করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলাম, সেই পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্ন গাইড বই থেকে নেওয়া। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এ রকম ঘটনা ঘটে, তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই ব্যাপার কেন ঘটবে না?

কাজেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভর্তি পরীক্ষায় আমরা চরমভাবে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন দেখতে পেয়েছি। এ ঘটনায় অনেকেই হয়তো অবাক হয়েছে, আমি মোটেও অবাক হইনি। ভর্তি পরীক্ষায় এ ধরনের ব্যাপার সব সময়ই ঘটে যাচ্ছে, আগে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এবার যেকোনো কারণেই হোক, এটি নিয়ে অনেকে মাথা ঘামাচ্ছে।

এবার শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে তা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। আমি ডেইলি স্টারে পড়েছি, তারা ভোররাতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়েছে, পরের দিন সেই প্রশ্নগুলো ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, সব মিলে গেছে। এই সংবাদপত্রের খবরের মধ্যে ভুল বা মিথ্যা হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্ন ফাঁসের এর থেকে অকাট্য প্রমাণ আর কী হতে পারে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য পুরোটা অস্বীকার করে রেকর্ড সময়ের ভেতরে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে ফেলেছে। এ রকম অবস্থায় এটি হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। একবার ফলাফল প্রকাশ করে ফেললে আর কেউ কিছু করতে পারবে না, ফলাফলে যাদের নাম চলে আসবে, এখন তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অন্য সবার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও আমরা সবাই জানি, আসলে সত্যি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস করার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম উঠে এসেছে। কাউকে কাউকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা চরম ঘোলাটে অবস্থা!

ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে ভালো ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্ন যারা পেয়ে গেছে তারাও চলে এসেছে। আমি যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কাজ-কর্মগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন দেখেছি, কেউ যদি এক নম্বর বেশি পেত, সে ৩০ জনকে ডিঙিয়ে সামনে চলে আসত। কাজেই যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তারা অন্য সব ছেলে-মেয়েকে ডিঙিয়ে অনেক সামনে এসে গেছে। তারাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হবে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের প্রশ্নগুলো দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষায় একটি অনেক বড় অমানবিক ঘটনা ঘটেছে জেনেও তারা দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষা করেনি, তারা দুর্বৃত্তদের অন্যায় করতে দিয়েছে। এর চেয়ে হতাশার ব্যাপার আর কী হতে পারে?

মাত্র অল্প কিছুদিন আগে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক এ রকম একটি মেয়ের কাল্পনিক একটি গল্প লিখেছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম—এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাওয়ার সময় রাতের বাস পথে দেরি করার জন্য মেয়েটি সময়মতো পৌঁছতে পারেনি বলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেনি। আমরা সবাই দেখেছি, এ রকম ঘটনা এখন মোটেও কাল্পনিক ঘটনা নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক এ ঘটনাই ঘটেছে। শত শত ছেলে-মেয়ে পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে সময়মতো পরীক্ষার হলে হাজির হতে পারেনি বলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

একজন ছাত্র বা ছাত্রী সমস্ত জীবন দিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যখন পরীক্ষাটি দিতে পারে না তখন তাদের কাছে কি পুরো জীবনটাই একটা অর্থহীন বিষয় মনে হয় না?

যদি সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিত, তাহলে এর কোনোটিই কিন্তু ঘটত না। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যদি একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করত, তাহলে সেটি হতো একটি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নপত্র, মোটেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার প্রশ্ন নয়। সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি সেই প্রশ্নপত্র ছাপাত, সংরক্ষণ করত, বিতরণ করত, তাহলে সেটি কখনোই ফাঁস হয়ে যেত না। যদি সবাই মিলে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা নিত, তাহলে সবাই নিজের এলাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিত, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হতো না। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে দেরি করে পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হয়ে পরীক্ষা দিতে না পারায় ভয়ংকর দুর্ভাগ্যটি মেনে নিতে হতো না।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই কেন আমি বুঝতে পারি না। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে যিনি সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করেছেন, তাঁকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে না, সেটি হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন। চারুকলা বিভাগের এই সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি পরীক্ষা নেওয়া। আমি বহুদিন ধরে অপেক্ষায় আছি, কখন হাইকোর্ট সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানতে চাইবেন কেন সবাই মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এ দেশের ছেলে-মেয়েদের ওপর একটি চরম অমানবিক নির্যাতন বন্ধ করছে না।

ছয়-সাত বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একবার একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তখন আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সামনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কিভাবে নেওয়া যায় তার ওপর একটা বক্তব্য দিতে। আমি গাধা টাইপের মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে উপাচার্যদের সামনে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সব উপাচার্যের সেই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াটির কথা আমি কোনো দিন ভুলব না এবং সোজা ভাষায় বলে দেওয়া যায়—আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, এ দেশের অসহায় ছেলে-মেয়েদের জন্য কারো মনে বিন্দুমাত্র মায়া নেই। তাদের পীড়ন করে কোনোভাবে কিছু বাড়তি টাকা আয় করা ছাড়া আর কারো মনে অন্য কোনো ইচ্ছা নেই!

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি অবশ্য এর থেকেও জটিল। যেহেতু কেউই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হতে চাইছে না, তাই তখন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আগ্রহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি—কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি—এ রকম বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মিলে সেই পরীক্ষাটি বন্ধ করার আয়োজন করেছিল। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যখন বামপন্থী দলগুলো সারা দেশে সভা-সমিতি করছে তখন তাদের আমার খুবই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, একেবারে নিজের ঘরের ছেলে-মেয়েদের সাহায্য করার এই বিপ্লবকে তারা কেন গলা টিপে হত্যা করেছিল?

একবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। সেই আলোচনায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। সেই বক্তব্য শুনে আমি খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, তারপর আর কিছুই হয়নি।

আমি একেবারে সত্যিকারভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম, যখন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং আচার্য সব উপাচার্যকে একটি সভায় সম্মিলিতভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দেশের ছেলে-মেয়েদের কষ্ট লাঘব করার অনুরোধ করেছিলেন। আমি যেটুকু জানি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধ দেশের আইনের মতো, সবাইকে এটি মানতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে! তারা রাষ্ট্রপতির অনুরোধ রক্ষা করেনি। আমার খুবই আশা ভঙ্গ হয়েছে, যখন এ বছর দেখতে পেয়েছি, আবার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে শুরু করেছে।

কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় আমি ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অনুরোধ করে এসেছি যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধটি রক্ষা করে তারা যেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটি উদ্যোগ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদের জানালেন, প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে এবং খবরের কাগজেও সে সম্পর্কে খবর ছাপা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, এটি ক্রমান্বয়ে কার্যকর করা হবে।

আমি ন্যাড়া এবং আমি বহুবার বেলতলায় গিয়েছি। কাজেই আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ‘ক্রমান্বয়ে’ কার্যকর করার বিষয় নয়। এটি ‘একবারে’ সবাইকে নিয়ে কার্যকর করতে হবে। যদি সেটি না করা হয় এবং কিছু কিছু প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থেকে যায়, তাহলে তাদের উদাহরণ দেখিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে। আলাদা ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য শুধু বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন। কাজেই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক নির্লোভ ও সাধুসন্ত হয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন—সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজি করাতে হবে জোর করে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই!

আরো একটি বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হয়, যেটি দেখে আমি বুঝতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি অনেকেই এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। সেই কথাটি হচ্ছে, ‘গুচ্ছ পদ্ধতি’, অর্থাৎ এক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ তৈরি করা হবে এবং তারা মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নেবে!

যে বিষয়টা অনেকেই বুঝতে পারে না সেটি হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ছাত্র-ছাত্রীদের কৃষি বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না! ছাত্র-ছাত্রীরা এখনো ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ হয়নি। তারা মাত্র এইচএসসি পাস করা ছাত্র। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান—এসব বিষয় পড়ে আসা ছাত্র। কাজেই তাদের যাচাই করার জন্য আসলে তারা যেসব বিষয় পড়ে এসেছে—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান—এসব বিষয়েই পরীক্ষা নিতে হবে! কাজেই গুচ্ছ তৈরি করে সেই গুচ্ছের জন্য আলাদা পরীক্ষা নিতে হবে সেটি কে বলেছে? সবাই মিলে একই পরীক্ষায় একই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশেষ কোনো বিষয়ে বেশি জোর দিতে চায়, সেটি তারা করতেই পারে, তার জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষা নিতে হবে না।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা অনেক বড় ইতিবাচক দিক আছে, যেটা অনেকেই জানে না। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং নামে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের নির্যাতন হয়, সেটিও চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রথমবার খানিকটা সময় পাবে নিজের জীবনকে উপভোগ করার জন্য, মা-বাবার অনেক টাকা বেঁচে যাবে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের আর ভর্তি কোচিং করাতে হবে না বলে।

আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি দেখার জন্য কী হয়। ভর্তি পরীক্ষার চলমান এই নির্যাতন শেষ হওয়ার পর সত্যি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়, আমি তাহলে আশায় বুক বাঁধার জন্য প্রস্তুত হব।

যদি কিছুই না হয়, তাহলে আবার শুরু করব ভাঙা রেকর্ডটি বাজিয়ে যাওয়ার জন্য।

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051259994506836