বিসিএস উত্তীর্ণ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ - দৈনিকশিক্ষা

বিসিএস উত্তীর্ণ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ

ড. নিয়াজ আহম্মেদ |

সম্প্রতি আমাদের মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী একটি সরকারি অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে একটি বিদ্যালয়ে ঢুকলেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে ফোর ও থ্রি বানান জিজ্ঞেস করলে মাত্র একজন উত্তর দিতে সক্ষম হয়। সংবাদটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষক ছিলেন এবং প্রত্যেকে বর্তমান বেতন স্কেলে সম্মানজনক বেতন পাচ্ছেন। গ্রামের জীবনযাত্রার মানের তুলনায় বেতন কম বলা যাবে না। শিক্ষকদের যোগ্যতা এতটাই কম নয় যে শিক্ষার্থীরা এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।

সমস্যা তাদের অযোগ্যতা নাকি দায়িত্বহীনতা, না অন্য কিছু তা ভাবার বিষয়। আরো ভাবার বিষয় শিক্ষার্থীদের শ্রেণি ও তাদের ক্যারিকুলাম বিবেচনা করে আমরা শিক্ষক নিয়োগ দিই কি না। অতিশিক্ষিত ও অতিমেধাবী যেমন প্রয়োজন নেই তেমনি একেবারে মেধাহীনদেরও দরকার নেই। প্রয়োজন মানানসই শিক্ষক। নইলে সুপিরিয়রিটি ও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স অনিবার্য হয়ে দেখা দিতে পারে। পূর্বোক্ত বিষয়টি সাধারণীকরণ করা হয়তো আমাদের ঠিক নয়, তবে সার্বিক চিত্র যে ভালো নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে এ বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত শিক্ষকদের আন্দোলনে দেশ উত্তাল ছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারকে দারুণ বেগ পেতে হয়েছে। কথা সত্য, শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল নেই, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা একেবারেই নেই, এমপিওভুক্ত হচ্ছে না বহুদিন ধরে। তা সত্ত্বেও মানুষ গড়ার কারিগররা যদি তাঁদের দায়িত্বে যত্নবান ও দায়িত্বশীল না হন, তাহলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কিভাবে গড়ব? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকার দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদাভুক্ত করেছে অনেক আগে। কিন্তু বেতন স্কেল নির্ধারণ করেছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীনদের যথাক্রমে ১১ ও ১২তম গ্রেডে। একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ১০ গ্রেডে থাকার কথা।

গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে যাদের চাকরি দেওয়া যায়নি তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে চাহিদা সাপেক্ষে পিএসসি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে আসছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কেননা সঠিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবীরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ পাচ্ছে। প্রথম দিকে অনেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করত। বিসিএস অফিসার না হলেও অফিসার পদে চাকরি পেত। মানসিক শান্তি কিছুটা পাওয়া যেত। একই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নম্বর একটু কম পাওয়ার কারণে ক্যাডার হতে পারেনি কিন্তু তাদের কম যোগ্যতাসম্পন্ন বলা ঠিক হবে না। আমার ব্যক্তিগত মত, এর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো মেধাবীদের নিয়োগ দিতে পারছে। আবার প্রতিটি বিসিএসে কোটা পূরণ না হওয়ায় অনেক পদ খালি থাকছে। কেননা টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল পদ অন্য কারো দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়।

অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী পরীক্ষার জন্য। এখানে সমাধান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা। ৩৫ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অথচ ক্যাডার পায়নি এমন বড় সংখ্যককে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় কিন্তু অনেকে সেখানে যোগদান করেনি। তারা হয়তো অফিসার হতে চেয়েছিল। শিক্ষকরা তো আর অফিসার নন। দ্বিতীয়ত, বড় ও যৌক্তিক কারণ বেতন স্কেলের বৈষম্য। পিএসসি দ্বিতীয় শ্রেণির নিচে কাউকে সুপারিশ করতে পারে না। সরকারি চাকরিই বড় বিবেচনা নয়, কারো কারো ক্ষেত্রে হতেও পারে, তবে বড় বিষয় গ্রেড জটিলতা। তাদের দশম গ্রেডে নিয়োগ দিলে তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তির ভাব লক্ষ করা যাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের গ্রেড পরিবর্তনের জন্য। ধরে নিলাম, তাদের গ্রেড পরিবর্তন হলো কিন্তু উত্তীর্ণদের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তন না হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো লাভ হবে না। তারা হতে চেয়েছিল সরকারি বড় কর্মকর্তা, থাকবে গাড়ি ও বাড়ি, কিন্তু হবে শিক্ষক। কতটুকু মেনে নিতে পারবে তারা! পৃথক স্কেল হলে মানিয়ে নেওয়া সহজ হতো। শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ কি! কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের শিক্ষকসমাজ কেউই সুখী নন। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কেননা তাঁদের সুযোগ-সুবিধা আইনগতভাবে বিসিএস কর্মকর্তাদের তুলনায় অনেক অনেক কম। আমাদের দেশে যে কারণেই হোক শিক্ষকসমাজকে অবহেলার চোখে দেখা হয়। বছরের পর বছর শিক্ষকরা এমপিওবিহীন থাকছেন।

আবার এ কথাও সত্য, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের গ্রেড পরিবর্তন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে রেখে তার কাছ থেকে ভালো সার্ভিস আশা করা কতটুকু সম্ভব? মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মননে অন্য প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের চেয়ে তারা সেরা হবে। শিক্ষকতা কোনো তত্ত্বাবধান, ফাইলওয়ার্ক কিংবা পরামর্শদানমূলক চাকরি নয়। অতীতেও আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা তরুণ-তরুণী যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে তখন তাদের কাছ থেকে ভালো সার্ভিস আমরা পাইনি। এখন বিসিএস পরীক্ষায় সদ্য উত্তীর্ণরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হবে তখন তাদের কাছ থেকে আমরা কতটুকু সার্ভিস পাব তা চিন্তার বিষয়। গ্রেড পরিবর্তন করতে পারলে তাদের মনোজগতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে বটে, তবে তা কতটুকু চাকরিতে প্রভাব ফেলবে তা দেখার বিষয়। কেননা চাকরির সঙ্গে মর্যাদার বিষয়টি জড়িত আর মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে তার গ্রেড ও বেতনের ওপর।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062320232391357