দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার বাড়ছে স্পুটনিক গতিতে। একইসঙ্গে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাংশ তাদের নামমাত্র বেতন দিয়ে কাজ করাচ্ছে। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বেকারের হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ কর্তৃক পরিচালিত ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক সমীক্ষামতে দেশে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক-স্নাতকোত্তরের মধ্যে বেকারের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
সে তুলনায় কম শিক্ষিতের মধ্যে বেকারের হার কম। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ার মধ্যে বেকারের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ বছরে ১০ লাখের বেশি যুবক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করার মিছিলে যোগ দিলেও সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও উচ্চশিক্ষিত বেকার সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা নিজে কিছু করার মতো দক্ষতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
শিক্ষিত বেকারের হার বৃদ্ধিকে সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখা হয়। এ সংকট উত্তরণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে অনেক এগিয়েছে।
আগামীতে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা রয়েছে। তারপরও বলতেই হবে, দেশের মূল সমস্যা দারিদ্র্য নেকড়ের মতো তাড়া করছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে ও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
বছরে আট লাখ বেকার বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকলে প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে অগ্রগতির ধারাকে ধরে রাখতে পারে না। এর একটি দৃষ্টান্ত নাইজেরিয়া। সন্তোষজনক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও দেশটিতে কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে আফ্রিকার সর্ববৃহৎ অর্থনীতির রাষ্ট্র বনে গেলেও বেকারত্ব ও বৈষম্য বৃদ্ধির চক্র থেকে দেশটি বের হতে পারেনি। নাইজেরিয়ার এ অবস্থা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে।
বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারা চলছে, তা ধরে রাখতে দরকার বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। তা না হলে বেকারত্বের লাগাম টানা যাবে না। সিপিডির গবেষণায় দেশে প্রতি বছর আট লাখ বেকার বাড়ার যে তথ্য উঠে এসেছে, তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
শ্রমবাজারে যে ধরনের দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন, সে অনুযায়ী কর্মীর চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এজন্য কর্মমুখী শিক্ষা পদ্ধতির ওপর জোর দিতে হবে। কাঠামোগত সমস্যার কারণে এ সমস্যাটি দূর হচ্ছে না।
আমাদের মনে রাখা দরকার, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির ধারায় শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না ঘটলে বেকারের সংখ্যা বাড়বেই। তাছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত, চামড়া খাত বিদেশি কর্মীনির্ভর হয়ে পড়েছে।
বিশেষায়িত কাজের জন্য দেশের ভেতরে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী না পেয়ে উদ্যোক্তারা বাধ্য হচ্ছেন বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন কাজের বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
লেখক: আর কে চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক; মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা