ভাইরাল শব্দটি বর্তমান সময়ে সব থেকে বেশি ব্যবহূত একটি শব্দ যেটি একই সঙ্গে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অথবা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের হতে পারে। মূলত ইংরেজি ভাইরাস থেকে আসা এ শব্দটির মানে হলো ভাইরাসজনিত। আবার এর আরেকটি অর্থ রয়েছে যেটির মানে দাঁড়ায় ব্যাপকভাবে অনলাইনে প্রচার। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০১৭ সালে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত শব্দগুলোর মধ্যে ‘ভাইরাল’ একটি। বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বর্তমান অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতাপের এই যুগে অনেক বিষয় মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে পড়ছে খুব সহজে। লোকে সেই ভাইরাল হওয়া বিষয় নিয়ে হাসাহাসি, মজা, সমবেদনা, ভর্ত্সনা, গালাগালি যা ইচ্ছা করছে। এই ভাইরাল হওয়া বিষয়ের কল্যাণে কেউ নিতান্ত পথের মানুষ থেকে হয়ে যাচ্ছে প্রাসাদের মানুষ। অখ্যাত জন থেকে বিখ্যাত বা ঠিক তার উলটোটা। কিছুদিন আগেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময় আমরা দেখেছিলাম একটি ইতিবাচক ভাইরালের নমুনা। ড. ফ র সিদ্দিকী, ভিন্ন চিন্তাধারায় লিখতেন বলে তার বই বছরের পর বছর ঘুরেও কোনো প্রকাশক পাচ্ছিল না।
বিষয়টি কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করলে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় সেটি এবং পরবর্তীকালে বইটি প্রকাশ করার জন্য অনেক প্রকাশক আগ্রহ দেখায় এবং প্রকাশিতও হয়। এ ধরনের ইতিবাচক ভাইরালের মাধ্যমে সমাজ অনেক বেশিই উপকৃত হতে পারে। মেধাবী, সৃষ্টিশীল, বঞ্চিত মানুষগুলোর প্রাপ্য মর্যাদা এবং অধিকার ফিরিয়ে দিতে এই ধরনের ভাইরাল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকে। মূলত এর উলটো দিকটিই আমরা আজকে দেখব। কেননা ভাইরাল যেমন ইতিবাচক বিষয় নিয়ে হতে পারে ঠিক এই ভাইরাল হতে পারে নেতিবাচক অথবা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপরেও। কিছুদিন আগেই পত্রিকায় একটি ছোটো নিবন্ধ পড়ছিলাম যেটি লিখেছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তিনি ক্লাস নিতে গিয়ে কোনো এক শিক্ষার্থীর পড়া না পড়ে আসার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলেন তার কি শাস্তি হওয়া উচিত।
পেছন থেকে আরেক ছাত্র ফস করেই বলে ফেললেন :‘মদ খা’। শিক্ষক বিস্মিত হলেন কিন্তু বুঝতে পারলেন এখনকার প্রজন্ম খুব অল্প বয়সেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত এবং এই মাধ্যমগুলোর কল্যাণে তারা ইতিবাচক বিষয়ের পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। অনেকে মজার ছলে বা গুরুত্বহীন মনে করে আবার অনেকে খুব ভেবে-চিন্তে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবগত হয়েও এমন কিছু বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা কেউ কেউ হয়তো শুধু মজা করার জন্যই গ্রহণ করছে কিন্তু নতুন প্রজন্মের মাঝে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেটি ভবিষ্যতে মানবিক মূল্যবোধ এবং আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সুস্থ ধারাকে ব্যাহত করবেই করবে।
যে কথাটি বলছিলাম, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী যখন শিক্ষককে ‘মদ খা’ শব্দটি বলতে পারে তখন বুঝতে আর দেরি হয় না যে সমাজে সে শব্দটির প্রচলন কতটা সাবলীল বা বহুল উচ্চারিত হয়ে গেছে। ঠিক তাই, আমাদের সমাজের কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ আছে যাদের কারণে আমাদের নতুন প্রজন্মের এই অবক্ষয়ের পথটি সব থেকে বেশি অবারিত হচ্ছে। এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষগুলো অন্য কারো সমালোচনা করতে গিয়ে কোনো প্রাসঙ্গিকতার বালাই না রেখে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে আর আমাদের ভাইরাল প্রজন্মের কল্যাণে সেটি হাসি-ঠাট্টার খোরাক হিসেবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যখন আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম দেখছে যে কারো সমালোচনা মানেই গালিগালাজ তখন তারা সেটাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। আবার এটা গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা আশপাশের মানুষগুলো থেকে নিষেধাজ্ঞার বদলে কিছুটা সমর্থনও পাচ্ছে। একটা সময় যারা শিখত কাউকে গালি দেওয়া যাবে না, কেউ কোনো ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এখন তারা সেটি না করে এমন সব অসামাজিক গালির চর্চা করেছে যা আমাদের সমাজেও ধীরে ধীরে একটা স্বাভাবিক জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষের মাঝে এই শব্দগুলোর একটা চলনসই মানে এসে গেছে। এখন আর সেগুলোকে কেউ তেমনভাবে নিষেধও করছে না।
আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের আরো একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে, ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন আগে যে দোল উত্সব উদ্যাপিত হয়েছে সে উত্সবে কিছু ছাত্রীর খোলা পিঠে এবং ছাত্রদের খোলা বুকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানটির বিকৃত রূপ যেটি রোদ্দুর রায় অনলাইনে ছড়িয়েছিলেন সেই গানের ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’ লাইনের আগে সেই অশ্লীল শব্দটি লেখা দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা খোলা পিঠে কেবল এঁকেই শেষ করেননি, বিকৃত ঐ গানটি গেয়েই ছাত্রছাত্রীরা নেচে বেড়িয়েছেন পুরো ক্যাম্পাস। এখান থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? অপ্রাসঙ্গিক ভাইরালের মধ্য দিয়ে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কতটা চরমে পৌঁছালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সেখানে অবলীলায় অংশগ্রহণ করতে পারে?
লেখক : ফরহাদ আলী, শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।