১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে বাংলাদেশের মুদ্রামান ভারতীয় মুদ্রামানের সমান ছিল। অর্থাত্ ভারতীয় ১০০ রুপি ভাঙালে পাওয়া যেত বাংলাদেশি ১০০ টাকা। তারপর ক্রমাগত বাংলাদেশি টাকার মান পড়তে থাকে। এক সময় অর্ধেকের কমে চলে এসেছিল। তবে কখনো কখনো বাণিজ্য ভারসাম্য করার জন্য টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল।
আবার কখনো টাকার অপচয়ন হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার স্বয়ংক্রিয় চাহিদা-জোগানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে দেশীয় মুদ্রার মান হ্রাস পেলে অপচয়ন হয়। অপচয়ন দেশীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে সরকার যখন ইচ্ছাকৃতভাবে রপ্তানি উত্সাহিতকরণের জন্য মুদ্রার মান হ্রাস করে তখন মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়। সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল রাশেদ।
ভারতীয় মুদ্রার মান হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভালো-খারাপ উভয় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিষয়টির জটিলতা সরকারের সিদ্ধান্ত এবং দেশের মানুষের ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতার ওপর নির্ভর করবে। ভারতীয় মুদ্রার মান এখন তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশি ১০০ টাকার বিনিময়ে ভারতীয় ৮৬ রুপি পাওয়া যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশি টাকা শক্তিশালী হয়েছে। টাকার শক্তি বৃদ্ধি দেশীয় জনগণকে ভারতমুখী অর্থাত্ ভারতীয় পণ্যের প্রতি স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ করবে। সাধারণত উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্সবকেন্দ্রিক কেনাকাটার জন্য পছন্দের তালিকায় পার্শ্ববর্তী ওপার বাংলার কলকাতা নগরী প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
প্রতিবছর ঈদ-পূজা কিংবা নববর্ষকে কেন্দ্র করে প্রচুর বাংলাদেশি কেনাকাটার উদ্দেশে কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় ভিড় জমান। বাংলাদেশের বাজারে প্রচুর ভারতীয় পণ্যের অনুপ্রবেশ ঘটে, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য হ্রাস পায়। ভারত নতুন করে রুপির অবমূল্যায়ন করার ফলে ভারতে আমাদের চিকিত্সা, শিক্ষা, ভ্রমণ এবং আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে কম টাকা খরচ হবে, দেশীয় মুদ্রা বাঁচবে।
অপরদিকে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু পূর্বের চেয়ে কম টাকায় দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে সেহেতু ভারতের বাজার বাংলাদেশকে আকৃষ্ট করবে। পূর্বের তুলনায় আমদানি কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় আমদানি-রপ্তানি প্রতিযোগিতা বিরাজমান।
যে রাষ্ট্রের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আমদানি আয়ের চেয়ে বেশি সে রাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতিতে তত প্রভাবশালী। আর যে রাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ রপ্তানির চেয়ে বেশি সে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে তত দুর্বল। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এখনও আমদানি নির্ভরতা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাত্সরিক বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো। যার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি ভারতের দখলে। অর্থাত্ ভারতের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান।
আমদানি-রপ্তানি পার্থক্যের কারণে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা দূরকরণে অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্ব্বী রাষ্ট্র মুদ্রার অবমূল্যায়নের আশ্রয় নেয়। ভারতও বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমদানি বৃদ্ধি করতে মু্দ্রার অবমূল্যায়নের পথ বেছে নিচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। রুপির মূল্যে অবমূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পাবে। দেশীয় কোম্পানিগুলো ভারতীয় বাজার হারাবে। যার ফলে বাণিজ্য ভারসাম্য আরো বেড়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন আমাদের আমদানি-রপ্তানি দুই দিকেই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অনেকে মনে করেন টাকার অবমূল্যায়ন বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে, রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে। তাই বাংলাদেশকে বাণিজ্য ভারসাম্য তৈরি করতে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করতে অত্যন্ত সতর্ক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক :আব্দুল্লাহ আল রাশেদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়