বাংলাদেশে প্রায় সব সমাজের বিশেষ করে শহুরে সমাজের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীর একটি বিরাট অংশ আজ মাদকের ভয়াবহ গ্রাসের শিকার। সম্প্রতি সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দেশে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি দাবানলের মতো এবং আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজ নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের পাশাপাশি ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ, খুন, গুম, পর্নোগ্রাফি, ইভটিজিং, অপহরণ ও অপমৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে অনায়াসে। সর্বনাশা মাদকের কারণে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজ একদিকে যেমন মেধাশূন্য হচ্ছে তেমনি আরেক দিকে তাদের মনুষ্যত্ববোধ এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় ও নৈতিকতার অবক্ষয় এমন এক অবস্থায় আজ উপনীত হয়েছে যে, কেউ কাউকে আর সহ্য করতে পারছে না। তাই এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীকে, এক আত্মীয় অন্য আত্মীয়কে, সন্তান বাবা-মাকে, বাবা সন্তানকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, ভাই ভাইকে, বোন ভাইকে, ভাই বোনকে নির্মমভাবে এবং অনায়াসে হত্যা করছে।
মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ মাদকাসক্তির জন্য একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত আট বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৭৭ থেকে ১০০ গুণ। সারাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ ইয়াবা ঢুকছে তার ৯০ শতাংশ আসছে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী রুট ব্যবহার করে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী হওয়ায় কক্সবাজার এখন ইয়াবা পাচারের মূল ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। এরপর তা জালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হচ্ছে তার ৫০ শতাংশেরও বেশি মিলছে কক্সবাজারে।
নেশা হিসেবে মাদকের প্রতি আসক্তি কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে শুরু হয় সিগারেট বা ধূমপান থেকে, সমবয়সীদের বা কখনো কখনো অসমবয়সীদের পারস্পরিক সাহচার্যে। মূলত নেশা এবং মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর, তরুণ ও যুবারা আজ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। মাদকের আসক্তির জালে একবার জড়িয়ে গেলে কেউ আর সহজে সে জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলেই মাদক স¤্রাট, মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধী ও সন্ত্রাসী চক্রের মূল টার্গেট এই কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজ, যাদের খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। ফলে প্রতিনিয়ত মাদকসেবীরা আরো বেপরোয়া ও বিপথগামী হয়ে ওঠে। মাদকের কারণে মা-বাবার হাহাকার ও কান্নার শেষ নেই। প্রতিটি পরিবারের মা-বাবা কিংবা আত্মীয়-স্বজন আজ মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে শঙ্কিত। মাদক মানুষের নৈতিকতা, মানবতা, বিবেক, মেধা ও মননকে নষ্ট করে দেয়। মাদক মানুষকে পশুতে পরিণত করে।
সমাজের মধ্যে মানুষ এক অদৃশ্য সামাজিক সম্পর্কের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় মানুষের কাছে সামাজিক আচরণ প্রত্যাশিত ও কাক্সিক্ষত। সামাজিক শৃঙ্খলার ছন্দপতন, সামাজিক সম্পর্কের শিথিলতা এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ক্রমহ্রাসমান অবক্ষয়ের কারণে বিপথগামী কিছু মানুষের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র কখনো কখনো হয়ে উঠছে অস্থির। বেশ কিছু মানুষের মন আছে আবেগ নেই, সমৃদ্ধি আছে শান্তি নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ^াস, ভালোবাসা, সংহতি আছে কিন্তু কোথায় যেন গভীর এক শূন্যতা ভর করেছে।
বিশ্বায়নের প্রভাবের জন্যে হোক আর সমাজ পরিবর্তনের যে কোনো কারণে হোক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ধারক ও বাহক মানুষের আচরণ আজ আর আগের মতো নেই। সেখানে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে মানুষ তার মনুষ্যত্ববোধ, মানবতাবোধ, বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ নিজের মধ্যে ধারণ করে, অন্যকে অনুকরণ করে, প্রয়োগের চর্চা করে সামাজিক হয়। কেননা একমাত্র মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার, নিয়ন্ত্রণের, রক্ষার, সুখসমৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক বলেই মানুষ সমাজে বাস করে, বনে পশুর মতো বাস করে না।
শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পর্ক ওতপ্রোত। একটি সমাজের বা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত ও শক্তিশালী, সে সমাজ বা রাষ্ট্রের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ততই নান্দনিক, মানবীয়, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন, উন্নত ও শক্তিশালী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, সমস্যাগুলোর সমাধান করে সময়োপযোগী করে আলোকিত মানুষ গড়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা দরকার। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক নিহত হয়েছে। মাদকের মাদকতা প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার জন্য যা যা করা উচিত তা করাও দরকার।
তবে যে বৃক্ষে সমস্যা তার ডালপালা না কেটে শেকড় একেবারে উপড়ে ফেলা উচিত। মাদক ব্যবসায়ী, মাদক সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবশ্য শুধু জেল জরিমানা দিয়ে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হয়নি বলেই আজ মহামারী আকার ধারণ করেছে। গ্রেপ্তারে দুয়েকটি ভুল হতে পারে, বন্দুকযুদ্ধে নয়। মৃত্যুতে নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি মৃত্যু মানে একটি পরিবার নিঃস্ব, পরিবারের সদস্যরা নিঃস্ব।
নিহতের পরিবারের সদস্য রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বড় হবে। ভবিষ্যতে অনেক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে তারা। প্রত্যেক ধর্মই তার স্ব স্ব অনুসারী মানুষের অন্তরে আলোকর্তিকা হিসেবে কাজ করে। আর তাই ধর্মীয় বোধ জাগ্রত করে মনের কালিমা দূর করতে হবে। কেননা ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রক, পথপ্রদর্শক, রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আজ সময় এসেছে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্বারোপের। কেননা মনে প্রাণে ধর্ম ও নৈতিকতাকে ধারণ করা ব্যক্তির পক্ষে মাদকের মাদকতায় নিমজ্জিত হওয়া বড় কঠিন।
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : শিক্ষক, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।
সূত্র: ভোরের কাগজ