সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) আবাসিক হলগুলোয় মাদকাসক্তদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রকাশ্যে হলে হলে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বললেও বাস্তব অবস্থা এর উল্টো। বরং স্বার্থ হাসিল করতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের প্রশ্রয় দিয়েছে প্রশাসন।
ক্যাম্পাসে হাত বাড়ালেই মেলে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি মাদক। ছেলেদের হলের পাশাপাশি মেয়েদের হলেও মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমান ভিসি যোগদানের পর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- আবাসিক হলে অছাত্ররা থাকতে পারবে না। মাদক নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এমন ঘোষণা শুধুই ফাঁকা বুলি। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকতে ছাত্রলীগের অছাত্র, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হলে থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ- প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হলগুলো এখন মাদক সেবনের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।
শাহপরান হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে অছাত্রদের হাত ধরে মাদক সেবন চলছে। ছাত্রত্ব শেষ হলেও মাদকাসক্তরা হলগুলোয় অবস্থান করছে। শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি তারিকুল ইসলাম নিয়মিত আবাসিক হলে অবস্থান করেন। ছাত্রত্ব শেষ হলেও তিনি নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা ও ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করছেন।
তারিকুলের অনুসারী এফইটি বিভাগের রাফসান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাইফ ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এ ব্যাপারে রাফসানের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও সাইফ কাছে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া ছাত্রলীগ নেতা ইমরান খানও ক্যাম্পাস ছাড়েননি। ২০১৭ সালে হল প্রশাসন তার রুমে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা, গাঁজাসহ বিদেশি ব্র্যান্ডের কয়েক বোতল মদ উদ্ধার করে। অভিযোগ- তিনিও হলে নিয়মিত মাদক সেবন করেন। তার অনুসারী শাখা ছাত্রলীগের উপ-দফতর সম্পাদক সজীবুর রহমান হলে মাদক সেবন করেন।
জুনিয়রদের নিয়ে তার মাদক সেবনের ভিডিও রয়েছে। ভিডিওতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিনের অনুসারী ২৩১ নম্বর রুমের তারেক হালেমীকেও দেখা যায়।
এ ছাড়া শাহপরান হলে ইমরান খানের অনুসারীদের মধ্যে এফইটি বিভাগের সাদ্দাম হোসেন লিখন, একই বিভাগের পল্লব শীল, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের মারভিন রিকি, তন্ময়, রাহী ও আসিফুর আসিফ নিয়মিত মাদক সেবন করেন। তাদের মধ্যে লিখনকে হল প্রশাসন মাদক সেবনের দায়ে সতর্ক করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মাদক সেবন করা হয়। হলের ৩০০৫ নং কক্ষে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা অবস্থান করেন। ৩০০৫ ও ৩০০৩নং কক্ষে প্রতিদিনই মাদকের আসর বসে।
এসব কক্ষে এসএন সাজ্জাদ রিয়াদ, আসাদুজ্জামান নুর, আফজাল, রাকিন, শাকিলসহ বহিরাগত ও মেসের শিক্ষার্থীদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়। ক্যাম্পাসের বাইরে শাবি শিক্ষার্থীদের মাদকসহ আটক হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। মাদক সেবন নিয়ে ক্যাম্পাসে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।
৩০ জানুয়ারি রাতে শাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মৃণ্ময় দাশ ঝুটন ও সহ-সম্পাদক নিউটন দাশের অনুসারীর মধ্যে কয়েক দফা হাতাহাতি হয়।
মাদক সেবনের বিষয়টি অস্বীকার করে শাবি ছাত্রলীগের উপ-দফতর সম্পাদক সজীবুর রহমান বলেন, রাজনীতি করি। অনেকে অনেক অভিযোগ দিতে পারে। কিন্তু মাদক-সন্ত্রাসের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
একইভাবে রুহুল আমিনের অনুসারী তারেক হালেমী বলেন, আমাদের অনেক শত্রু আছে। সামনে নতুন কমিটি হবে, এ জন্য হয়তো কেউ এগুলো ছড়াচ্ছে। ভিডিওর ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এফইটি বিভাগের ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন লিখন বলেন, ছয় মাস ধরে আমি হলে থাকি না। রাজনীতি করার কারণে হয়তো কেউ এসব ছড়াচ্ছে।
শাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান জানান, দু’বছরের অধিক সময় চিকিৎসাধীন থাকায় শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারিনি। শিক্ষাজীবন চলমান করার জন্য হাইকোর্টে রিট করেছি। হাইকোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শোকজও করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মাদক ও অস্ত্রের রাজনীতির ঘোরবিরোধী। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শাহপরান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান খান বলেন, মাদকের ব্যাপারে তাদের শতভাগ জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। তিনি জানান, হলে অছাত্ররা থাকতে পারবে না বলে নোটিশ দিয়েছি। হলে শৃঙ্খলা ফেরাতে সময় লাগবে। তবে অবশ্যই আমরা সব অপকর্ম নির্মূল করে ছাড়ব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. হাসান জাকিরুল ইসলাম জানান, হলে বহিষ্কৃত ও অছাত্ররা থাকছে এমন তথ্য তার জানা নেই। জানা গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রক্টর অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমদ বলেন, এর আগেও একবার বক্তব্য দিয়েছি। এ সব ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলাম। কিন্তু তার বক্তব্য খণ্ডিত ছাপা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হলে কারা থাকছে সে ব্যাপারে প্রভোস্টরা ভালো বলতে পারবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, হলে হলে ছাত্রলীগের অনেক অছাত্র থাকে।
ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাতে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখেছি- অন্ধকারে টং দোকানগুলোয় ছেলেরা গাঁজা খায়। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে মাদক নির্মূলে পুরো বছরের কর্মসূচি নিয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। ডোপ টেস্টের মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কে কী বলল তাতে কী আসে যায়। সবার কথা শুনতে পারব না। একদিনে তো আর সবকিছু সমাধান করা সম্ভব নয়। একটু সময় লাগবে। কারা বহিষ্কৃত, অছাত্র ও মাদকসেবী তাদের তালিকা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।