মানসম্মত শিক্ষা ও সুশাসনের অঙ্গীকার চাই - দৈনিকশিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষা ও সুশাসনের অঙ্গীকার চাই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসার একটি লক্ষণীয় বাস্তবতা। এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৪টি। বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৫ ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এসব বিশ্ববিদ্যালয় 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০'-এর আলোকে ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর সরকারি কোনো আইন-কানুন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে 'উচ্চশিক্ষার গুণমান নিশ্চিতকরণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাকরণ' বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডের ভেতর থেকে খুব জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়নি। সাম্প্রতিককালে এ বিষয়গুলো শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি প্রকল্প উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প সংক্ষেপে 'হেকাপ' হাতে নেয়। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম রাউন্ডে মোট ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় (১০টি সরকারি ও তিনটি বেসরকারি) এই প্রকল্পের অধীনে আসে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ৬৯টি বিশ্ববিদ্যালয় (সরকারি ৩৩ ও বেসরকারি ৩৬) এই প্রকল্প শেষ করেছে; যদিও এই প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই অনেক তর্ক-বিতর্ক ছিল। এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ প্রস্তুতকৃত স্বনির্ধারণী প্রতিবেদনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও প্রোগ্রামগুলো 'বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল' দ্বারা উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে সক্ষম বলে বিবেচিত হওয়ার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবে। এ কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রম (র‌্যাংকিং) নির্ধারণ করে প্রকাশ করবে। আমরা জানি, 'বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল বিল ২০১৭' সংসদে পাস হয়েছে। এই বিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট (একজন সভাপতি, চারজন স্থায়ী ও আটজন অস্থায়ী সদস্য) এই কাউন্সিলটি একটি স্বাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে, সেগুলোকে এই কাউন্সিল সনদ প্রদান করবে। ইতোমধ্যে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সভাপতি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়কারী এবং সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণের কোনো বাস্তবসম্মত প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি। সে কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটিই বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি বা পারছে না। যেহেতু আমরা বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করায় অনাগ্রহী ছিলাম; তাই উচ্চশিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে। এই প্রকল্পকে সফল ও টেকসই করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অভ্যন্তরে একটি 'মান নিশ্চিতকরণ ইউনিট' এবং প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে 'প্রাতিষ্ঠানিক মান নিশ্চিতকরণ সেল' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম, মানসম্মত পাঠ্যক্রম তৈরি, গবেষণা, জ্ঞান উৎপাদন, বিতরণ ও শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা-সহায়ক সেবা কার্যক্রম নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। এটির আওতায় সব বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কেমন, সেটি এখন সবাই জানতে পারবে।

কিন্তু এটি অনস্বীকার্য যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকই পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক, দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগের সেলফ এসেসমেন্ট কমিটি প্রাতিষ্ঠানিক মান নিশ্চিতকরণ সেলের সহায়তায় প্রতিবেদন তৈরি করেছে এবং এটির মাধ্যমে বিভাগগুলোর সক্ষমতা, দুর্বলতা, সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি বিভাগগুলো এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আগামী চার বছরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ও মান নিশ্চিতকরণ ইউনিট উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্থায়ীভাবে কাজ করার কথা।

আমি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সেলফ এসেসমেন্ট কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনের (পাঁচ ধরনের অংশীজন- শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চাকরিদাতা) কাছে প্রশ্নমালা নিয়ে গেছি। তারা গুরুত্বসহকারে তাদের মন্তব্য জানিয়েছেন। এই প্রশ্নমালাতে নয়টি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- সুশাসন, মানসম্মত পাঠ্যক্রম তৈরি, পর্যালোচনা, শিক্ষার্থী ভর্তি, সাফল্য ও অর্জন, ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা-শিখন ও মূল্যায়ন, শিক্ষার্থী-সহায়তা সেবাগুলো, কর্মী (শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী), সুযোগ-সুবিধা; গবেষণা ও প্রসার, ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া ও ধারাবাহিক উন্নয়ন। একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে খুব গুরুত্বসহকারে নেয়া দরকার। সেলফ এসেসমেন্ট ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এই নয়টি বিষয় উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে অতি জরুরি।

সেলফ এসেসমেন্ট ম্যানুয়াল (হেকাপ, ডিসেম্বর ২০১৪) অনুযায়ী উল্লিখিত নয়টি বিষয়কে বিবেচনায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগকে আগামী চার বছরে (২০১৯-২০২২) উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কথা। এভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো প্রথম বছর মান যাচাই এবং পরবর্তী চার বছর উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে নিম্নলিখিত সুপারিশমালা বিবেচনায় নিতে এই প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-

ক. 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০'কে আরও আধুনিক, যুগোপযোগী এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবান্ধব করা। সেই আলোকে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই নিজস্ব বিধিমালা থাকা; খ. বাজার চাহিদা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানসম্মত ও সময়োপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরি করা। পাশাপাশি সামাজিক দক্ষতা ও নৈতিকতার মানোন্নয়নে পাঠ্যক্রমকে যুগোপযোগী করা; গ. উচ্চশিক্ষা কেবল মেধাবী শিক্ষার্থীরাই গ্রহণ করতে পারে। সেটির জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রতিযোগিতামূলক করা; ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা; ঙ. শিক্ষা-শিখন প্রক্রিয়া যাতে মুখস্থনির্ভর না হয়, সেদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া; চ. সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অভিন্ন 'মূল্যায়ন নীতিমালা' প্রণয়ন করা; ছ. শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরে সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যকর জ্ঞানচর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা; জ. শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া ও শর্ত যুগোপযোগী করা। শিক্ষকদের পিএইচডির জন্য সরকারি বৃত্তির ব্যবস্থা করা; ঝ. সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতাসহ যেসব সুবিধা পেয়ে থাকেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সেগুলো চালু করা। উদাহরণস্বরূপ পেনশন ও বৈশাখী ভাতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে; ঞ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে 'পাঠদান বিশ্ববিদ্যালয়' অথবা 'গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে চিহ্নিত করা; ত. বাজার চাহিদা অনুযায়ী ও সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ তৈরি করা জরুরি। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্প খাতের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করতে হবে এবং গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ নিশ্চিত করা; থ. বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া ও শিক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ করা এবং শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা, অবসরের বয়সসীমা নির্ধারণ, অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত করা; দ. অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলকে যোগ্য, দক্ষ, নির্ভীক এবং নীতিবান ও নিষ্ঠাবান শিক্ষাবিদদের দ্বারা পরিচালিত করা।

পরিশেষে বলতে চাই, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী উচ্চশিক্ষা কমিশনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।

শেখ নাহিদ নিয়াজী : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077550411224365