মানসম্মত শিক্ষা প্রবর্তনে বিবেচ্য বিষয় - দৈনিকশিক্ষা

মানসম্মত শিক্ষা প্রবর্তনে বিবেচ্য বিষয়

ড. মো. নাছিম আখতার |

সেসময় আমাদের দেশে শিক্ষিত লোক কম ছিল। সামাজিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠিপত্রের আদান-প্রদান। গল্পটি এমন একটি সময়ের। গ্রামের এক নিরক্ষর ব্যক্তি তার এক শিক্ষিত প্রতিবেশীর নিকট একটি চিঠি লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। অনুরোধের প্রত্যুত্তরে শিক্ষিত ব্যক্তিটি বলেন, ‘আমি চিঠি লিখতে পারব না। কারণ আমার পায়ে ব্যথা’। অশিক্ষিত ব্যক্তিটি আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘তোমার পায়ে ব্যথা কিন্তু হাত দিয়ে লিখতে অসুবিধা কি?’ উত্তরে শিক্ষিত লোকটি বলেন, ‘চিঠি লিখলে আমার আবার বাড়ি গিয়ে পড়ে দিয়ে আসতে হবে। তাই আমি লিখে দিতে পারছি না।’ প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ্য ভদ্রলোকের হাতের লেখা এতই খারাপ যে, এর পাঠোদ্ধার কেবল তিনি করতে পারবেন। গল্পটি নিছকই একটি মজার গল্প। আমার একুশ বছরের চাকরি জীবনের প্রথমদিকে হাতের লেখা খারাপ এমন খুব কম শিক্ষার্থীই পেয়েছি। তাদের লেখার মধ্যে ছিল এক ধরনের মনঃসংযোগ, একাগ্রতা এবং কোনো বিষয় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যত্নশীলতা। কিন্তু বর্তমানে সবক্ষেত্রেই এর অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষাই জাতির উন্নতির একমাত্র মাধ্যম। আর আমাদের জন্যে এটা আরও বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে দক্ষ মানবসম্পদই আমাদের একমাত্র অবলম্বন।

ছেলে-মেয়ে উভয়েই স্কুলে পড়ে এবং নিজে একটি বিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিনিধি। স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে দেখছি এবং এই নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখাও লিখেছি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। আমি যে লেখাগুলো লিখেছিলাম তা ছিল আমার বিবেচনা ও বিশ্লেষণ প্রসূত। কিন্তু এবারের যে লেখাটি তা একজন প্রবাসী বাঙালি শিক্ষকের বর্ণনাকে উপজীব্য করে লিখছি। দীর্ঘ ২২ বছর পশ্চিমা বিশ্বের একটি দেশে তিনি বসবাস করছেন। পেশায় তিনি সেখানে একটি ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

প্রবাসী শিক্ষক মহোদয় এক মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তার ভাষ্যমতে, ঐ দেশের স্কুল, কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘শিথিল বলতে কী বোঝাচ্ছেন স্যার?’ তিনি বললেন, যেমন ধরুন হোমওয়ার্ক না করে স্কুলে গেলেও কিছু বলা যায় না। আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করলেও শাস্তির বিধান নেই। খুব বেশি হলে বাবা-মাকে ডাকা হয়। ফলে শিক্ষকরা সর্বদাই কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে থাকেন। কারণ তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীদের উপর থাকে না। তাই জীবন তৈরির জন্যে যে প্রত্যয় নিয়ে বেড়ে ওঠা উচিত তা তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে তারা গবেষণামূলক কাজে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে সেখানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইমিগ্র্যান্ট বা স্কলারগণ। ফলে পিছিয়ে পড়ছে তাদের প্রকৃত জনগোষ্ঠী। ঐ শিক্ষকের ভাষ্যমতে, যখন ২২ বছর আগে তিনি উন্নত দেশটিতে গিয়েছিলেন তখন তিনিই ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বাংলাদেশি শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে ঐ দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ান বংশোদ্ভূত শিক্ষকের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৩০ জন। পরিসংখ্যানটিকে নেতিবাচকভাবে দেখলে বলতে হয় উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে উন্নতবিশ্বের নাগরিকদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা পর্যায়ক্রমে কমছে। আবার ইতিবাচকভাবে বললে বলতে হয় পড়াশোনার ক্ষেত্রে এশিয়ানদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

কথোপকথোনের এক পর্যায়ে তিনি ঐ দেশের শিক্ষক নিয়োগের একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। উনার বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৯২টি দরখাস্ত জমা হয়। দরখাস্ত পূরণের নিয়ম-কানুন মেনে পূরণ করেছিলেন মোট ৭২ জন চাকরিপ্রার্থী। দরখাস্তগুলো পূরণের ক্ষেত্রে মোট তিনটি বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখা হয়-কভার লেটার, জীবন বৃত্তান্ত এবং সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া। সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া সুন্দরভাবে পূরণের জন্যে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ৭২টি দরখাস্ত সিলেকশন কমিটির কাছে উপস্থাপন করলে তারা তা যাচাই-বাছাই করে ৬ জনকে ইন্টারভিউ দেওয়ার আহ্বান জানান। এই ৬ জনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে যে দু’জন শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন তারা দু’জনই বাংলাদেশি। এদের মধ্যে একজন ঐ দেশেই কর্মরত ছিলেন অন্যজন ছিলেন ভিয়েতনামে কর্মরত। তারা বাংলাদেশের দুটি ভিন্ন ভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। গর্বের সাথে তিনি বললেন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম নবনিযুক্ত দু’জন শিক্ষকই দুই থেকে পাঁচ বছর আগে পিএইচডি শেষ করেছেন। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশে তাদের স্কুল ও কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান ধাঁচের সৃজনশীল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

আমরা প্রায়ই বিভিন্ন বক্তব্যে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলি। তথ্য মতে, মানসম্মত শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা যা মানুষের সম্ভাবনাময় বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতাকে বিকশিত করে। মানসম্মত শিক্ষা প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী তৈরি করে। প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠী হবে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ে পারদর্শী এবং যাদের থাকবে কোনো অজানা বিষয়ে শেখার জন্য প্রত্যয় বা হার না মানা মনোভাব। প্রত্যয়ী শিক্ষার্থী তৈরির জন্যে ভিত্তি জ্ঞানের উপর জোর দিতে হবে। শক্তিশালী ভিত্তিজ্ঞান এর অধিকারী শিক্ষার্থী যে কোনো অজানা বিষয়ে মনোসংযোগ করলেই সেই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছেন। তাই মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবনে তার নিজস্ব প্রজ্ঞা এবং বিবেচনা বোধই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়াতে আমাদের ওপর থাকে প্রভাবশালী দেশের খবরদারি। এছাড়াও থাকে বিশ্ব ব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন ধরনের দিক-নির্দেশনা। পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষা ও গবেষণায় যখন এশিয়ানদের প্রাধান্য দিন দিন বেড়েই চলেছে ঠিক তখন আমরা দাতা সংস্থাগুলোর দিক-নির্দেশনায় তাদের স্কুল এবং কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুকরণ করার চেষ্টা করছি। শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় বিবেচ্য হওয়া উচিত তা হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এই দেশগুলোতে জনশক্তির বড়ই অভাব। জনসংখ্যার অভাবে বা শ্রমের উচ্চ মূল্যের কারণে তাদের কারখানাগুলোতে রোবটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের রয়েছে আয়তনের তুলনায় বিশাল জনসংখ্যা যা কেবল মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করলেই বিশ্ব বাজারে সমাদৃত হবে। তাই কোনো দেশের অনুকরণের ক্ষেত্রে হতে হবে সাবধানী। ভবিষ্যতের প্রত্যয়ী শিক্ষার্থী গড়ার পদক্ষেপই আমাদের জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতির বিকাশে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0082199573516846