মানুষ তৈরির কারখানা চাই - দৈনিকশিক্ষা

মানুষ তৈরির কারখানা চাই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সারাদেশের মানুষকে চমকে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পুরোনো। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি এবং এর সঙ্গে যুক্ত ছাত্রলীগের বিশাল অঙ্কের ঈদ সেলামি রীতিমতো অবিশ্বাস্য। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ কথা জানা যায়। 

নিবন্ধে  আরও জানা যায়, আবার বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি ও উপাচার্যের ভূমিকায় দেশবাসী স্তম্ভিত। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তার নজির নেই। সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। শুধু ভিন্নমত প্রকাশ বা স্বাধীনভাবে চলার কারণে সতীর্থকে ছয় ঘণ্টা ধরে রোমহর্ষক নির্যাতন করে হত্যা করা এবং হত্যার পর তাদের আচরণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ত ভূমিকা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন জড়িত।

উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলোর সত্যিই বেহাল দশা। এক দিনে নিশ্চয়ই তা হয়নি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঘটে চলা অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা এতদূর গড়িয়েছে যে- ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসন কেউই তাতে অন্যায় কিছু দেখেনি। দলবাজি প্রশাসনের অঙ্গ হয়ে গেছে। সামান্য ভিন্নমত অসহ্য তাদের কাছে। গণতন্ত্রের মৌল শর্ত যে ভিন্নমতের অবাধ চর্চা ও প্রকাশ, এর অবসান ঘটেছে। দলের ক্যাডার ছাত্র বাহিনী এখন সবকিছুর নিয়ন্তা। সবকিছুর ঠিকাদারি তাদের। তাতে ছাত্রলীগ, দল, সমাজ বা শিবিরে কোনো তফাত নেই।

যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তাদের ছাত্র সংগঠনের একচেটিয়াতন্ত্র চলে। তারা সবকিছুতেই বেপরোয়া। কাগজে-কলমে যাই-ই থাক, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কথার বাইরে কারও পক্ষে আইন মেনে দায়িত্ব পালন অসম্ভব। ফলে উপাচার্য হয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতের পুতুল। জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবীর চোখে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অব্যবস্থাপনা নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। সিনিয়র ভাইয়েরা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে চিরকালই আদর্শ।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‌্যাগিংয়ের যে ভয়াবহ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে সবার হাতে হাতে ঘুরছে, তা কি কল্পনা করা যায়? এর নাম আদব কায়দা? ভব্যতা শেখানোর নামে অশ্নীল গালাগাল, কান ধরে ওঠবস করানোতেই থামে না তারা। উচ্চারণ অযোগ্য শব্দে, কর্মে তালিম দিতে পৈশাচিক উন্মত্ততার যে ছবি, সেটাই কি তবে আমাদের অধঃপতিত সমাজের প্রকৃত চেহারা? তাও আবার বছরের পর বছর ধরে এই কুশিক্ষার চর্চা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোয়! চলছে শিক্ষক, প্রশাসনের নাকের ডগায়, তাদের সম্মতিতেই, সহযোগিতায়! কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সর্বত্র! বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বছরের পর বছর!

এই শিক্ষা লাভের জন্য বাবা-মা তাদের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান? এসবের প্রতিবাদ যে হয়নি, তাও নয়। প্রতিবাদ হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরে, বুয়েটে র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিচার চেয়েছে; কিন্তু বিচার দূরে থাক, আরও হিংস্র, আরও কুৎসিত হেনস্তার শিকার হয়েছে ভুক্তভোগীরা। শুধু বুয়েটেই জমা হয়েছিল শতেক অভিযোগ। কিন্তু প্রতিকারে কেউ এগিয়ে আসেননি। অন্যায়কারীর বিচার তো দূরের কথা, কোনো উদ্যোগও নেননি কেউ! তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ কী? প্রক্টরের কাজ কী? কী দরকার মাথাভারি প্রক্টরিয়াল বডি পোষার? ছাত্র কল্যাণ পরিষদের দরকার কী? বিভাগীয় প্রধান, ডিন, সহ-উপাচার্য, উপাচার্য নিয়োগের দরকার কী? হলে প্রভোস্ট নিয়োগ কেন?

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের হামলার কালরাতে উপাচার্য ছিলেন ইউরোপে। সেখান থেকেই ২৭ মার্চ তিনি 'আমার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে' বলে গর্জে উঠেছিলেন। তিনিই প্রথম কোনো বাঙালি উচ্চ পদাধিকারী, যিনি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। ছাত্ররা ছিল তার 'সন্তান'। আর বুয়েটে আবরার হত্যার পর আমরা কী দেখলাম? উপাচার্য ব্যস্ত উচ্চমহলের নির্দেশ পেতে? তাতে লাগল প্রায় ৫০ ঘণ্টা! ৫০ ঘণ্টা পর, তাও বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের আন্দোলন, আলটিমেটাম, অফিসে তালা লাগানোর পর, তিনি এলেন দায়সারা বক্তব্য নিয়ে? শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষকের, উপাচার্যের, প্রভোস্টের সন্তানতুল্য না হবে, তাহলে কার কাছে বাবা-মা জানের টুকরো সন্তানকে পাঠাবেন?

ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, জগন্নাথসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই। বাকৃবি, কুয়েট, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুলসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র মোটামুটি একই। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাভাবিক ছবি। এটা শুধু এই সরকারের আমলে নয়, স্বাধীনতার পর থেকে এটাই এ দেশের সাধারণ চিত্র! বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু ডিগ্রি দেওয়া নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ মানুষ তৈরি করা; হেনরি নিউম্যানের ভাষায়, 'ভদ্র মানুষ'; আধুনিক পরিভাষায় মানবিক গুণে গুণান্বিত দক্ষ মানুষ। আর সে জন্য সবার আগে শিক্ষকদের হতে হবে দক্ষ, ভদ্র ও মানবিক। বর্তমানে বাংলাদেশে এর অভাব সবচেয়ে বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নেই, ভিন্নমতের ছাত্রদের কোনো অধিকার নেই কথা বলার, মিছিল করার, দাবি উত্থাপন করার। তাহলে এই সমাজ এগোবে কী করে? সংশয় যদি না থাকে, প্রশ্ন যদি না থাকে, প্রশ্ন যদি উত্থাপন করা না যায়, তাহলে সমাজ এগিয়ে যাওয়া দূরে থাক, সে সমাজ কী করে টিকে থাকবে? ন্যায্য হিস্যা চাওয়া কি অপরাধ? বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলা কি অপরাধ? বিচার চাওয়া কি অপরাধ?

যদি অপরাধ হয়, তবে নেতৃত্বের বিকাশ হবে কীভাবে? বঙ্গবন্ধু আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে গেছেন। ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ইস্পাতকঠিন লড়াই চালানোর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। মূল্যবোধ চর্চার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সোনার বাংলা গড়ার জন্য তিনি মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন আমৃত্যু। আমরা কি তাহলে সে শিক্ষা ভুলে যাব? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কত গভীর সংকটে নিপতিত, আবরার ফাহাদ জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে গেছেন। শিক্ষার নামে দানব তৈরির কারখানা বন্ধ করতেই হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হবে মানুষ তৈরির কারখানা। এখন আমাদের দায়িত্ব আবার মানুষ হওয়ার শপথ নেওয়া, ব্রত গ্রহণ করা। মোসাহেবিমুক্ত এক সত্যিকারের বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম শুরু করা।

লেখক: আমিরুল আলম খান,যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053660869598389