মোজাফফর আহমদকে লাল সালাম - Dainikshiksha

মোজাফফর আহমদকে লাল সালাম

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সংসদ সদস্য ও মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। যে কারণে কমরেড মোজাফফর আহমদের প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে এত শ্রদ্ধা; সেই কারণটি হল- বাংলাদেশকে তিনি ভালোবেসেছেন নিজের চেয়ে বেশি। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন জেড এম কামরুল আনাম।

ইতিহাস বলে- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বহুদলীয় মতের ভিত্তিতে। সে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন অনেক দলের নেতাকর্মী। ন্যাপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তাদের অন্যতম।

এরা সপ্রাণ অংশগ্রহণ আর ত্যাগে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় গুণ ছিল মানুষ চেনা। চিনতেন বলেই তাকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছিলেন, যিনি ও যার দল শেষদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার প্রতি অনুগত ছিল। ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে রাজনীতি করার শুরুটা আগে জানুন। ১৯৩৭ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে আছেন ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। আদর্শবাদী সাধু পুরুষ। সবার কাছে তিনি পরিচিত মহাত্মা গান্ধী নামে। তিনি দেশ সফরে বেরিয়েছেন। আসবেন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায়।

চান্দিনায় তার জনসভা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা দেবিদ্বারের কিশোর মোজাফফর আহমদ হেঁটেই রওনা দিলেন জনসভার উদ্দেশে। কিন্তু জনসভাস্থলে পৌঁছার আগে সভা শেষ হয়ে গেল। কিশোর মোজাফফর পথিমধ্যে এ কথা শুনে সভা ফেরত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন, মহাত্মা গান্ধীজি কী বলেছেন?

লোকেরা উত্তর দিল, তিনি বক্তৃতা নয়, বাণী দিয়েছেন। বাণীতে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে যাও। ব্রিটিশ তাড়াও। নিজেরা ভেদাভেদ করলে ইংরেজ তাড়াতে পারবে না। কৌতূহলী মোজাফফর জানতে চাইলেন, আর কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিল, গান্ধীজি আর কিছু বলেননি। এটুকু বলেই রওনা দিয়েছেন।

মুগ্ধ হয়ে গেলেন পনেরো-ষোলো বছরের বালক মোজাফফর। এমন নেতাই তো চাই, যারা কথা কম বলেন, কিন্তু কাজ করেন বেশি। তাকে দেশবাসী গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ময়দানে, জনসভায়, মিছিলে লুঙ্গি পরে ছুটতে দেখেছে। হ্যাঁ, প্রথাবিরোধী রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা এমনই।

মোজাফফর আহমদ যে আদর্শের জন্য লড়েছিলেন তার প্রতি আমাদের আস্থা থাকলেও স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার তা রাখতে পারেনি। আজ সত্য বলতে হলে বলতে হয়, ১৯৭৩-এর নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কেন্দ্রে জেতা ন্যাপ প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ সেদিন যদি এই পরাজয় না হতো ন্যাপের রাজনীতি ওই এলাকায় বৃদ্ধি পেত।

তাতে কী হতো? অন্তত আজকের মতো ওই এলাকা জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি হতে পারত না। যেমনি করে দাউদকান্দিতে পরাজিত খন্দকার মোশতাককেও জিতিয়ে আনা হয়েছিল। আর তার ফিরে আসার মাশুল আমরা গুনেছি পঁচাত্তরে। মোজাফফর আহমদ সত্য বলতেন সাহস করে।

সে কারণে আইয়ুব আমলে যেমন হুলিয়া থাকায় আত্মগোপন করেছিলেন, একইভাবে আত্মগোপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। প্রলোভনে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ ছিল না বলেই চলে গিয়েছিলেন লোকজনের চোখের আড়ালে। সম্বল শুধু রিকশা ভাড়া। মন্ত্রী তিনি বঙ্গবন্ধু আমলেও হতে পারতেন।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই- তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক ধারার একটি যুগের অবসান হয়েছে।

কালের রাজনীতিতে বাম আদর্শের নীতিবান রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মায়ের নাম আফজারুন্নেছা।

মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইন্সটিটিউশন, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ালেখা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ইউনেসকোর ডিপ্লোমা লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী ছাত্র বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি ও তার স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের প্রাথী ও ওই সময়কার শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপনে থেকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন।

১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইয়ুব খানের আহ্বান করা রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন তিনি। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে অন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি^তা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে কারারুদ্ধ হন তিনি। কারণ তিনি ছিলেন প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং মনোভাবের মানুষ। ছবি দেখলেই বুঝবেন সারল্য আছে, আছে প্রাণখোলা ভাব।

কথাও বলতেন জমিয়ে। বাংলাদেশে যে কটি রাজনৈতিক দল থাকলে আমরা লাভবান হতাম ন্যাপ তার একটি। একটা সময় তিনি এবং তার সহকর্মী পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন আদর্শ আর অনুপ্রেরণার প্রতীক। অবারিত আলোর মানুষ হিসেবে বরাবরের মতো আজও তার জন্য নিবেদন আমাদের পক্ষ থেকে লাল সালাম।

জেড এম কামরুল আনাম : চেয়ারম্যান, সেভ দ্য রোড; সাবেক চেয়ারম্যান, সোনাগাজী উপজেলা পরিষদ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0082249641418457