উচ্চশিক্ষিত তরুণ ফাহাদ হোসাইন। সিলেটের এমসি কলেজে থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। অনেক চেষ্টা করেও সরকারি চাকরি ভাগ্যে জুটেনি তার। তাই বাধ্য হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে তানিয়া আহমেদ ও লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে সুইডেনে পাড়ি জমিয়েছেন মিছবাহুদ্দোজা রুজেল। ২০১৬ সালে ডেনমার্ক পাড়ি জমিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান উদ্দিন রাজু। শুধু এই চার তরুণ-তরুণী নয়, প্রতিবছর এমন উচ্চশিক্ষিত হাজারো তরুণ-তরুণী পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বেকারত্ব ঘোচানো ও উন্নত জীবনের আশায় বিদেশকেই বেছে নিচ্ছেন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা, এমনটাই বলছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না বিধায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। আর চাকরির আর্থিক নিরাপত্তা না থাকায় বেসরকারি সেক্টরেও আগ্রহ কমেছে তরুণদের। তাদেরকে ধরে রাখতে হলে রাষ্ট্রকে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ-তরুণীরা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন, তারপরেও চাকরি হয়নি। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সুযোগ-সুবিধাও কম, চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। এসব কারণেই মূলত উচ্চশিক্ষিতরা বিদেশমুখী।
পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। ২০১০ সালের পর থেকে এ হার বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুর্যোর হিসাব অনুযায়ী ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ শ্রম শক্তির বাইরে। ইউনেস্কোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষার নামে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ৯৩ হাজার ৫৮০ জন শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৬০ হাজার ৩৯০ ও ২০১৫ সালে ৩৩ হাজার ১৩৯ জন শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়েছেন। তবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশ গমনের উদ্দেশ্য যদিও উচ্চশিক্ষা, কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশুনা ছেড়ে উপার্জনের জন্য রেস্টুরেন্টসহ নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। তবে যারা স্কলারশিপ পেয়ে যাচ্ছেন, তাদের বিষয়টি ভিন্ন। তবে এই সংখ্যাটা খুবই অল্প বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এসবের বাইরেও ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরা।
জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, ‘দেশে চাকরি না পেয়ে হতাশা হয়ে যেসব উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বিদেশে যায়, তাদের জন্য জীবন অনেক কঠিন হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা হতাশ হয়ে যায়, কারণ স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার প্রায় মিল থাকে না। সফলতারও অনেক দৃষ্টান্ত আছে, তবে যারা প্রচুর পরিশ্রম করতে পারে, তারা সফল হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী নয়। শিক্ষার্থীরা অপ্রয়োজনীয় ডিসিপ্লিন থেকে পড়াশুনা করে, যেগুলোর চাকরির বাজার এ দেশে নেই। এ ছাড়া এ দেশে কোন সেক্টরে কত গ্র্যাজুয়েট দরকার, সেটার কোন পরিসংখ্যানও নেই। এজন্য বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।’
পোল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফাহাদ হোসাইন বলেন, বিদেশ যাওয়ার পেছনে দেশে চাকরি না পাওয়ার ব্যাপার তো আছেই, পাশাপাশি সবাই চায় নিরাপদ ও উন্নত জীবন। তাছাড়া বিদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আয় করা যায় বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এজন্যই শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বিদেশকে বেছে নিচ্ছেন বলে তার অভিমত।
ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ। শুধু মালয়েশিয়াতেই শিক্ষা ভিসায় বাংলাদেশ থেকে গমন বেড়েছে ৪২২ শতাংশ। ২০১৬ সালেই উচ্চশিক্ষার নামে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন ৩৪ হাজার ১৫৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। এরপর শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় ছিল যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, সৌদি আরব, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। এছাড়া সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পাড়ি জমিয়েছেন।
সৌজন্যে: ইত্তেফাক