শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি নামে পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি মহোদয় হন পরিষদের সর্বময় কর্তা। সাধারণত কোনো সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা (ইউএনও/এডিসি/ডিসি) বা কোনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়ে থাকেন। তবে ম্যানেজিং কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সভাপতিত্ব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্যান্সারের মতো ক্ষতি করছে।
প্রভাবশালী রাজনীতিকরা সভাপতি হলে তাদের পছন্দের দলীয় শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানে না এসেই বছরের পর বছর বেতন নিয়ে সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা তছরুপ করেন। সভাপতিরাও ঐ সব শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীরা সভাপতির মাধ্যমে টেন্ডারসহ বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে অল্প দিনে অঢেল টাকার মালিক হয়ে যান। এভাবে সারা দেশে কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী রাজনৈতিক সভাপতিদের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও এই রাজনৈতিক সভাপতিরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করেন।
সম্প্রতি দেখা যায় তারা এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন। নিয়োগপ্রাপ্তরা টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে তাদের যোগদানে বাধা দেয়া হয়।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় নানা সময়ে নিজ দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালায়। ফলে শ্রেণি কার্যক্রমের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। অন্যদিকে কমিটির মিটিং থাকলেও তারা তাদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বা বাসায় যেতে বলেন। আবার যখন প্রতিষ্ঠানে মিটিং এর জন্য আসেন তখন অনেক নেতা-কর্মী নিয়ে আসেন। যার ফলে আপ্যায়নে যেমন অর্থ ব্যয় হয়; তেমনি শ্রেণি কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটে।
এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সভাপতির আগমনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তার দু’ধারে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠান বা তার ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানেও লোক সমাগম বেশি দেখাতে ও তার নিজস্ব ভাবমূর্তি বাড়াতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তার দু’ধারে বা কোনো খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেন।
প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কোনো অনুষ্ঠানে (পরীক্ষার্থীদের বিদায়/ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা/ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী ইত্যাদি) সভাপতি তার ভাবমূর্তি বাড়াতে এমপি/মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী নেতাদেরকে আহ্বান করেন। ফলে একদিকে যেমন আপ্যায়নের ও তাদের উপঢৌকন দিতে প্রতিষ্ঠানের বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ হয়; তেমনি কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাজ করতে হয়। এমনকি শিক্ষকদেরকে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতেও বাধ্য করা হয়।
প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও সভাপতি মহোদয়েরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়াও দেখা যায়, অন্য কোনো অফিসের পিয়ন/মালী/ করণিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটির সদস্য হলে তারা না বুঝে না শুনে শিক্ষকদের সঙ্গে অসদারচণ করেন। যা অনেক সময় অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য কমপক্ষে স্নাতক পাসের বিধান থাকা দরকার এবং শিক্ষকদের সমপর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়া দরকার। রাজনৈতিক সভাপতিদের কারণে অশিক্ষিত সদস্যরাও শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণের সুযোগ পেয়ে যায়।
তবে, হ্যাঁ আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তি অনুদানে প্রতিষ্ঠিত। তাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রতিষ্ঠাতাদের গুরুত্ব দিতেই এই ব্যবস্থার চালু হয়। কিন্তু বর্তমানে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সরকারি সহকর্মীদের কাছাকাছি। তাই সময় এসেছে পরিবর্তনের।
এক্ষেত্রে কোনো সরকারি কর্মকর্তা (ইউএনও/এডিসি/ডিসি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকে। সব শিক্ষক-কর্মচারী প্রতিষ্ঠানমুখী থাকেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। এ বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে সভাপতির পদ থেকে বাদ দিয়ে কোনো সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাকে সভাপতি নির্বাচন করা উচিৎ বলে আমার মনে হয়।
লেখক: শিক্ষক
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]