মহান দার্শনিক সক্রেটিস অনেককাল আগে বলেছিলেন, ‘নো দাইসেলফ’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। এটিই নাকি মানুষের জন্য সবচেয়ে মহৎ এবং কঠিন কাজ। তাই আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে নিজেকে জানার সাফল্য লাভ করা কঠিন। তবে মাঝে মাঝে আত্মোপলব্ধি করার চেষ্টা করি। ছেলেবেলা থেকে শিক্ষক হওয়ার প্রবল বাসনা থেকেই শিক্ষক হয়েছি। তাই কেউ সরলভাবেও যদি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চাকরি’ করছি, তখনি আমার মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কী, শিক্ষকতার তিনটি দশকের অধিককাল পেরিয়ে এসে আজ আমি খুব বিষণ্ন ও বিব্রত। দেখছি কী এক মোহে শিক্ষক আমরা অনেকেই নৈতিকতার জায়গা থেকে একটু একটু সরে যাচ্ছি। এতে শিক্ষার্থী ও জাতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একবারও ভাবছি না। আমলা না হয়ে, নানারকম ন্যায়-অন্যায়ে যুক্ত থেকে নিজেকে ক্ষমতাশালী ও অর্থশালী করার লোভকে প্রশ্রয় না দিয়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় এসেছি, যে আদর্শকে লালন করে তাকে সম্মান দিচ্ছি না।
দুটো উদাহরণ দিয়ে আমার বক্তব্য প্রকাশ করতে চাই। সম্ভবত ২০১৩-এর শেষ দিকের কথা। ছিপছিপে গড়নের সাদামাটা চেহারার একটি ছাত্র এলো আমার কাছে। গায়ের রং শ্যামলা। কথা বলার ঢংয়ে একটা বিনীত ভাব। বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব। সেসময় আমি শিক্ষকতার বাইরে অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব পালন করতাম। ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব। সে সূত্রে মাঝে মধ্যে বিচিত্র সব বিষয়ে পরামর্শ চাইতে আসত ছাত্ররা। এই অফিসে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা মনোবিজ্ঞানী আছেন। তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নানা জটিল ও বিচিত্র মনো-সমস্যা রয়েছে। ভালো লাগে যখন দেখি মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে থেকে অনেক ছেলে-মেয়ে সংকট হতে বেরিয়ে আসছে।
আরো একটি কাজ করত এই কেন্দ্র। তালিকা তৈরি করা হয়েছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। যে অভিভাবকরা বাড়িতে পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটর চান এবং যে ছাত্ররা টিউশনি পেতে আগ্রহী আমরা তাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
এই দুই প্রয়োজনেই ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি আসত কেন্দ্রে। অবশ্য এসবের জন্য আমার কাছে সরাসরি আসার প্রয়োজন পড়ত না। ফলে এই ছেলেটির আমার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কারণ চট করে বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওকে সামনের চেয়ারটিতে বসতে বললাম। সামান্য দ্বিধা নিয়েই ও সব কথা খুলে বলল। ধরে নেই ওর নাম মাসুদ। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে পড়ছিল। বলল, ওর নিজের কথা। সাতক্ষীরা বাড়ি ওর। বরাবর মেধাবী ফলাফল করেছে। মেধার প্রমাণ রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল মাসুদ। তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন স্কুলের শিক্ষক কবির স্যার এবং এলাকার বড় ভাই শেখ ইয়াসিন। তাঁরা আর্থিক সহায়তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। বাবা ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ছয় জনের সংসার নির্বাহে হিমশিম খান। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। মাসুদ তিনটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। চেষ্টা করে বাবাকে পাঁচ-সাতশ টাকা পাঠাত। আর প্রতিদিন কর গুণে হিসেব করত কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবে। চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরবে। ওর কাছে এক একটা দিন এক একটি বছরের মতো।
এর আগে তিন বছরে রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী ঝামেলায় মাঝে মাঝে ক্লাস পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটেছে। সামান্য সেশন জট তৈরিও হয়েছিল। সেই তুলনায় গত একবছর স্থিতিশীল ছিল দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। এর মধ্যে নানা কারণে মাসুদের আর্থিক সংকট বেড়েছে। এখন সেশন জটের আশঙ্কা ওকে বিমর্ষ করে। সে বছর মে মাস থেকে ওকে খুব শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল ভিসি পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের একটি অংশের আন্দোলন। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাস নিলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অনেকেই নিচ্ছিলেন না। কষ্টের সঙ্গে মাসুদ জানাল, যখন অধিকাংশ কোর্সের ক্লাস শেষের দিকে তখন আন্দোলনকারী ওর এক শিক্ষক মাত্র দুটো ক্লাস নিয়েছিলেন। কারণ তাঁর ঘাড়ে ছিল নেতৃত্বের বড় চাপ! শিক্ষকদের ক্লাস ধর্মঘট ও ব্যক্তিগত অসাধুতায় ক্লাস না নেওয়ার কারণে ওদের হিসেবে ছয়মাস থেকে একবছর সেশন জটের ফাঁদে পড়ে যাবে। মাসুদের পক্ষে টিকে থাকার সংগ্রামে এ এক কঠিন সংকট।
মাসুদ প্রশ্ন করে, স্যার, এথেকে বেরোনোর উপায় কী? শিক্ষকরা কি আমাদের কথা একবারও ভাববেন না?। আমি বিব্রত। কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললাম, মাসুদ, এর উত্তর আমার জানা নেই। পরক্ষণেই মনে হলো এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়তো! সত্যি কি উত্তরটি আমার জানা নেই?
দ্বিতীয় উদাহরণটি বছর দুই আগের। কলা অনুষদের কোনো এক বিভাগে পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী। ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সক্রিয় কর্মী। একজন ভালো বিতার্কিক। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছে। কিছুদিনের মধ্যে হল ছাড়বে। এসেছিল ওদের একটি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতে। ওর জানার কৌতূহল বেশ। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসে। সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করে।
সেদিন একটি কষ্টের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিল। ভূমিকাতেই বললো, ‘স্যার, জানি আপনি কিছু মনে করবেন না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে কথাটা বলেই ফেলি। আমরা তো সম্মানের উঁচু জায়গাটিতে আমাদের শিক্ষকদের বসাতে চাই। কিন্তু এখন ভাবনা হচ্ছে অনেক শিক্ষক কি তা চান! অন্য কোনো প্রসঙ্গ নয়। আমি শিক্ষকদের অনেকের দায়িত্ব পালনে সংকট ও আমাদের অসহায় অবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাই।’
অতঃপর ছাত্রীটি ওর অভিব্যক্তি যেভাবে বর্ণনা করল আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা এর চেয়ে খুব দূরে নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন অনুষদের কিছুসংখ্যক শিক্ষক এখন ক্লাস না নেওয়ার ঘরানা তৈরি করছেন যেন। ছাত্র-ছাত্রীরা এসে ঘুরে যাচ্ছে আর প্রায়ই শিক্ষকের দেখা পাওয়া যায় না। ফলে এমন হচ্ছে কোনো বিভাগে যদি একটি বর্ষে ৭টি কোর্স থাকে তবে নিয়মমাফিক রুটিন অনুযায়ী হয়ত ৩টি কোর্সের ক্লাস শেষ হয়েছে যথাসময়ে। পাশাপাশি দেখা যাবে বাকি ৪টি কোর্সের ২০ শতাংশ ক্লাসও হয়নি। হয়ত এই শিক্ষকদের জন্য পরীক্ষা আটকে থাকবে ৬ মাস। অথবা তারা ৫/৭টি ক্লাস নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে শেষ করবেন। হয়ত একদিনে টানা তিনটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নিয়ে কোনো নিয়ম অনুসরণ না করে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করবেন। ছাত্রীটি জানালো, কলা অনুষদের একটি পুরানো বিভাগ পরীক্ষা নেওয়ায় এগিয়ে আছে। এর রহস্য হচ্ছে সিলেবাস অনুসরণে পাঠদান করা সেই বিভাগের শিক্ষকদের জন্য জরুরি নয়। সবার আগে পরীক্ষা নেওয়ার কৃতিত্বটাই বড় করে দেখছেন। নিরুপায় হয়ে সব মেনে নিতে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের।
ছাত্রীটি বললো স্যার, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা বেরুতে চাইনি। প্রথম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম তখন ক্লাস না নেওয়ার রোগ এত প্রকট ছিল না। এখন অনেকটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে গেছে। এই রোগের কারণ স্পষ্ট। আগে দু’ একজন পণ্ডিত শিক্ষক নানা ব্যস্ততার কারণে কিছু কম ক্লাস নিতেন। এখন পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। একজন নবীন শিক্ষক পেশা জীবনের শুরুতেই ফাঁকি দেওয়ার সবক নিচ্ছেন যেন!
অনেকে প্রকৃত বাস্তবতার খোঁজ না নিয়ে সার্বিকীকরণ করে বলেন, নানা প্রজেক্টে যুক্ত থেকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় গিয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দিতে পারছেন না। এমন ধারণার সত্যতা খুবই কম। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন শেষে অতিরিক্ত সময় বের করেই সাধারণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান শিক্ষকরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে ও শর্ত মেনে। প্রজেক্টের জন্য সেভাবেই সময় বের করে নেন। এসব বরঞ্চ শিক্ষকের দক্ষতাই বৃদ্ধি করে। তবে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার হিসেবটা অন্যদিকে। শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র রয়েছে। শিক্ষক রাজনীতির নেতাদের অধিকাংশের মুখ দিয়ে নানা ব্যস্ত থাকার কথা শোনা যায়। নানা সভা, মিটিং ইত্যাদি সামাল দিয়ে অনেক সময়ই আর ক্লাসমুখো হতে পারেন না। আমার একজন সহকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন, বিভাগের একাডেমিক কমিটির জরুরি সভা হচ্ছে—হয়ত শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দু’জন শিক্ষক তাড়া দিতে থাকেন তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করুন; আমাদের গ্রুপ মিটিং আছে!
শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা, প্রমোশনের নীতিমালা, গবেষণা ইত্যাদির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অনেক সময় থাকে না। থাকলেও তা সকল সময় মান্য করা হয় না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চাকরির ধারা ও শিক্ষকদের শিক্ষকতা ও গবেষণার ধারা অভিন্ন নয়। ফলে সভ্য দেশগুলো একই কাঠামোতে বেতনের হিসেব করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-সম্মান নির্ণীত হয় তার শিক্ষা-গবেষণার মূল্য বিচারে। বয়সের বিচারে অবশ্যই নয়। আমাদের দেশে সকল ক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত বলে ভালো মন্দের কোনো ভেদ রেখা নেই। ফলে দায়িত্ববান মেধাবী শিক্ষকের সামনে যেমন হতাশ হওয়ার অনেক কারণ উপস্থিত হয় তেমনি রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে আসা অনেক শিক্ষক নিজেদের দায়িত্বশীল হওয়ার আর মেধা চর্চার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেন না। দলীয় আশ্রয় তাকে সকল বৈতরণী পার করে দেয়। অমন অবস্থা বিরাজ করলে তা আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিশ্চয় অশনি সংকেত। ইউজিসির মাধ্যমে বিষয়টি ভেবে দেখা যায় কিনা তা সংশ্লিষ্টজনদের বিবেচনায় রাখতে অনুরোধ করব।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়