রাজনীতির চর্চা যদি আজ সঠিকভাবে এগিয়ে যেত তাহলে বর্তমান দেশ বা শিক্ষাঙ্গন এমন বিভ্রান্তিতে পড়ত না। শিক্ষাঙ্গনে আজ যেখানেই অরাজকতা সেখানেই রহস্য উদ্ঘাটন করলে দেখা যায় এর পেছনে মূল হোতা ছাত্ররাজনীতি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল ছাড়া কোনো মহৎ কাজ করতে দেখিনি। আমি দেখেছি তাদের অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্তিতে পড়তে। কল্যাণের অজুহাতে যে ছাত্রসংগঠন খুন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না সেই সংগঠনের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো একই ধাঁচের রাজনীতি চর্চা করে। বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের দৌরাত্ম্য ছিল, বর্তমানে ছাত্রলীগের। নামে নয় কাজে যদি বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ হতো তাহলে হয়তো বর্তমান শিক্ষাঙ্গন সত্যিই শিক্ষাবান্ধব হতো। মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যানুসারে, গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এই ২৪ জনের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আট জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো তিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে!
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির কারণে মূলত এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
২০০৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির রাতে চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন কায়সারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শাহ আমানত হল ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন নিহত হন। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ রাতে শাটল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে চবি মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদকে গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিত্ দাস।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একজন ছাত্র হয়ে আরেক জন ছাত্রকে খুন করার এখতিয়ার কি কোনো সংগঠনের গঠনতন্ত্রে আছে? সমান্য একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস যদি একজন বুয়েট ছাত্রের মৃত্যুর কারণ হয় তাহলে সেই ছাত্রসংগঠনের থেকে কতটুকু সমাজিক উন্নয়ন দেশ বা জাতি আশা করতে পারে। যে ছাত্রসংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে পাশে থাকবে এমন ছাত্ররাজনীতি চাই। যে ছাত্রসংগঠন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, টেন্ডারবাজিতে জড়িত এমন ছাত্রসংগঠন কাম্য নয়। দেহবল যখন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যথেষ্ট নয়, তখন মুক্ত কলম হোক অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাতিয়ার। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় হোক নোংরা ছাত্ররাজনীতিমুক্ত।
শিক্ষাঙ্গন হবে মুক্ত জ্ঞান আহরণের স্বাধীনতম আবাসস্থল। যেখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করাসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক ও সামাজিক কাজকর্ম করা হয়ে থাকে। সুতরাং মনের বিরুদ্ধে নয়, শিক্ষাঙ্গন হোক মনের ভাব বা চেতনাকে বহিঃপ্রকাশের অন্তস্থল।
বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাত্ উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে গবেষণা। গবেষণার জন্য একেক জনের ভিন্ন রকম চিন্তা-চেতনা থাকাটাই স্বাভাবিক। সবার চিন্তা এক নয়। যেখানে চিন্তা ভিন্ন সেখানে মতাদর্শ ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই স্বাধীনতাটুকু না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তজ্ঞান চর্চা বা আহরণে বাধাগ্রস্ত হবে।
ফারহানা নওশিন তিতলী : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।