শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্বের কথা কমবেশি সবারই জানা। মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম অধিকার যে শিক্ষা, তা আমাদের সংবিধানস্বীকৃত। দিনবদলের অঙ্গীকারে শিক্ষার কোনো বিকল্প হতে পারে না। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি বিদেশি সাহায্যনির্ভরতার অভিশাপমুক্ত। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশ যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন যুগান্তকারী সাফল্য আমরা দেখতে পাই না। এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের যেতে হবে আরো বহু দূর। আমরা এগিয়েছি এ কথা শতভাগ সত্য-শুদ্ধ, কিন্তু এর চেয়ে আরো অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারতাম যদি শিক্ষাব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
৫৭ বছর আগে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী তথাকথিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ বাতিলকরত সবার জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা করে একটি গণমুখী বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক শিক্ষানীতির জন্য ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এরপর একে একে কয়েকটি ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ বিভিন্ন সময় আলোর মুখ দেখলেও সেই বহু কাঙ্ক্ষিত গণমুখী, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সহজলভ্য, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। তাই আমার মতো অজপাড়াগাঁর একজন সাবেক প্রধান শিক্ষকের আকুতির সঙ্গে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার আর্তনাদ মিলে উচ্চারিত হয়—সাতান্ন বছর কেটে গেল, পরাধীন দেশ স্বাধীন হলো, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হলাম, তবু আজও শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকর ও অর্থপূর্ণ করতে সেই বোষ্টমি আর এলো না।
সারা দেশে দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছেন। ৯ বছর এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকার পর এক হাজার ৬৫১টি স্কুল ও কলেজ, ৫৫৭টি মাদরাসা এবং ৫২২টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত জুলাই থেকে বেতন-ভাতার সরকারি অংশ পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চালু থাকলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যুক্তিসংগত দাবি পূরণ হলে জাতীয় প্রেস ক্লাব বা শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন, আমরণ অনশন বা ধর্মঘট বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন—এটাই অভিভাবকরা প্রত্যাশা করেন। ধর্মঘট, আমরণ অনশন যেমন আমাদের কাম্য নয়, তেমনি পুলিশের লাঠিচার্জ মৃদু হলেও কাঙ্ক্ষিত নয়। বর্তমান শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাস্তবায়ন করার সরকারি ঘোষণা থাকলেও বর্তমান অবস্থায় তা বাস্তবায়ন সুদূরপ্রসারী! ৬২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল অর্জনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে বিগত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৌখিকভাবে ন্যস্ত করলেও প্রশাসনিক জটিলতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় তা হস্তান্তর হচ্ছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের জন্য অবকাঠামো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সর্বোপরি অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ব্যতিরেকে রাতারাতি তা বাস্তবায়নও সম্ভব নয়।
আমাদের ‘ঝরে পড়ার’ অন্যতম কারণ ‘শিখন সংকট’ (Problem of learning) গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে অত্যন্ত প্রকট। সংখ্যায় ও গুণগত মানে গ্রামের স্কুলগুলোতে উপযুক্ত শিক্ষক খুবই কম। গত ১৪ অক্টোবর ২০১৯ ‘গণশিক্ষার জন্য প্রচার অভিযান’ নামক একটি সংস্থার প্রতিবেদনে দেশে মাধ্যমিক শিক্ষার একটি হতাশাজনক চিত্র ওঠে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, ৩৭ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাদানের জন্য গাইড বই ব্যবহার করেন এবং তাঁরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতেও অক্ষম। সেই প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫৫ শতাংশ ইংরেজি ও অঙ্কের শিক্ষক নিজ নিজ বিষয়ে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নন। সত্যি বলতে কী, বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও অঙ্কের ডিগ্রিধারী শিক্ষকই নেই। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ছোট-বড় যেসব দুর্বলতা রয়েছে তার অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে এ দুটি বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষকস্বল্পতা। ইংরেজি, অঙ্ক বা বিজ্ঞানে যাঁরা মেধাবী তাঁরা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করবেন এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা খুবই কম। এখানে শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ যেমন সীমিত, তেমনি বেতন-ভাতাদি খুব আকর্ষণীয় নয়। দশম গ্রেডের একজন সহকারী শিক্ষক ১৪-১৫ বছরেও পদোন্নতি পান না। অথচ দেশে সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য আমরা তাঁদের দিকেই তাকিয়ে থাকি। এভাবে শিক্ষকদের একদিন সব ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে অবসরে যেতে হচ্ছে। শিক্ষার সব পর্যায়েই যদি শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত ও সম্মানজনক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে একজন শিক্ষক অবসরে গিয়েও কিছুটা শান্তি ও স্বস্তি পেতেন। আমি অবসর জীবনে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের খুব কাছে থেকে দেখার যে সুযোগ পেয়েছি, তা খুব সুখকর নয়। কেন যেন শিক্ষকদের নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখচ্ছবিই আমার মানসনেত্রে ভেসে ওঠে। বর্তমানে স্কুলে একজন করে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; এর আগে দেখতাম স্কুলের টয়লেটে পানি ঢালা থেকে ঝাড়ু দেওয়া, ঘণ্টা বাজানো সব শিক্ষক মহোদয়েরই করতে হতো। যেসব স্কুলে শিক্ষক ও ক্লাসরুম সংকট, সেসব স্কুলে দুই ব্যাচ করে পড়াতে হয়। এর মধ্যেও আবার পাঠদানের পরিবর্তে তাঁদের সরকারি ফরমান বাস্তবায়নে মাঠে নেমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, গ্রামের খানা গণনা, স্যানিটারি ল্যাট্রিনের হিসাব থেকে অনেক কাজই করতে হয়। দেশের কয়জন মানুষ জানে—শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক দেশের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী? জানে না! জানে না বলেই আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষকদের সংস্পর্শকে সাধারণ মানুষ বাঁকা চোখে দেখে। দেশের মানুষের কাছে তাঁরা যে সম্মান প্রত্যাশা করেন তা তাঁরা সুদে তো দূরের কথা, আসলেও পান না, বাকিতে যে কোনো দিন পাবেন, সে ভরসাও করেন না।
আমার মতো একজন অতি সাধারণ প্রধান শিক্ষকের সাদামাটা চোখও অনুসন্ধান করলে দেখতে পায় গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও নিরক্ষর পরিবার থেকে। যাঁরা তুলনামূলক সচ্ছল ও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করান আনাচকানাচে গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন বা এজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এভাবে একটা বৃহৎ গোষ্ঠীর সন্তানরা তাদের নিরক্ষর মা-বাবা বা স্বজনদের কাজ থেকে বাসায় ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, বাংলা তো দূরের কথা, বর্ণমালাটাও শেখার সুযোগ পাচ্ছে না; পক্ষান্তরে অল্প কিছু সন্তান শিক্ষিত মা-বাবা ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের সাহায্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে বাহবা কুড়াচ্ছে, আর তার আত্মীয়-স্বজন দেদার দিচ্ছে মারহাবা, মারহাবা! এতে আমাদের শিক্ষাক্রম যেভাইে তৈরি হোক না কেন, দেশের ধনী-দরিদ্র, স্বাক্ষর-নিরক্ষর অভিভাবকদের সন্তানের মধ্যে একটি বিশাল বৈষম্য তৈরি হচ্ছে! যদিও কিন্ডারগার্টেনের মুখস্থবিদ্যা বা বাক্বাকুম শিক্ষা উচ্চশিক্ষার জন্য খুব একটা কাজে আসে না। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দরিদ্র ও নিরক্ষর অভিভাবকদের সন্তানের সুশিক্ষার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা প্রাথমিক শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। যে শিক্ষকরা তাঁদের মেধায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা করছেন, তাঁরা অবশ্যই বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন। দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমান সরকার শিক্ষকদের আর্থিক আনুকূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে চলেছে, তা দৃশ্যমান। এখন প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের ভালো থেকে আরো ভালো করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও তাঁদের একটু অঙ্গীকার।
আজকে সময় এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষার যত মাধ্যম আছে সবগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে তাদের মধ্যকার সীমাহীন বৈষম্য দূর করা। একাত্তরে আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যদি এক পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শ্রেণি বৈষম্যহীন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে এই বিজয়ের মাসে শিক্ষকদের অঙ্গীকার হোক—সব সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা ও ভুলভ্রান্তি দূর করে নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত একটি উন্নত বাঙালি জাতি হিসেবে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলা।
লেখক : বাপ্পু সিদ্দিকী, প্রধান শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ