শিক্ষা সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষাই মানুষকে বন্য জীবন থেকে সভ্যতার আলোয় ফিরিয়ে দিয়েছে। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ হিসেবে তৈরি করে। বিশেষ করে সমাজে সবাই ঘাড় উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে চায়। মেরুদণ্ডহীন হয়ে বাঁচার শখ বা স্বাদ কারো নেই। আমরা অনেকেই ‘শিক্ষিত’ বলে গর্ব করি, কিন্তু শিক্ষার আসল রূপ কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে আমরা অবগত নই। সেজন্যই আমাদের মধ্যে এডুকেশন পদ্ধতি, আবার কেউ কেউ ইনস্টিটিউশন পদ্ধতি অবলম্বন করি। সে যাই হোক, নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা ও সুদৃঢ়রূপে গড়ে তুলতে আমরা জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় ওই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে ব্যয় করি।
এরপর নানা কষ্টে অর্জিত শিক্ষাকে পদে পদে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিই। বর্তমানে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়- ‘আজকালকার স্কুল-কলেজগুলোর হালচাল খুবই দুর্বল। বর্তমানে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী প্রশংসাপত্র আদায়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়, শিক্ষা গ্রহণের জন্য নয়।’ এসব কথাবার্তা সত্য হলেও শুনে শুনে স্বভাবতই শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মনে একটি ঘৃণার ভাব জন্ম হতে পারে। বিস্ময় জাগে এটা ভেবে যে, আজকালকার শিক্ষা যতই বৃত্তিমুখী হোক না কেন, বিনা শিক্ষালাভে কি প্রশংসাপত্র অর্জন করা সম্ভব? কেউ শুধু শিক্ষালাভকে উদ্দেশ্য করেই স্কুলে যাক বা প্রশংসাপত্র লাভকে উদ্দেশ্য করে স্কুলে যাক, সর্বতোভাবে তাকে প্রথমে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
প্রতিষ্ঠান কি কোনো অযোগ্যকে যোগ্যতার স্বীকৃতি দিতে পারে? এই বাস্তব কথাটি আজকের শিশুদের বিশ্বাস করানোর ক্ষমতা নেই। ছোট ছোট শিশুরাও ভালো করে বুঝে নিয়েছে, টাকা হলে বাঁকাপথে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। কথায় বলে- ‘বাতাস না এলে গাছের পাতা নড়ে না।’ শিক্ষাব্যবস্থার ভিতরেও যে নিশ্চয়ই এক বিষাক্ত বাতাস বইছে তা ধ্রুব সত্য। নিত্যদিনের নানা শিক্ষা কেলেঙ্কারির প্রকাশিত খবর অস্বীকার করার উপায় নেই। বলতেই হবে, কোনো এক অদৃশ্য, অশুভ শক্তি থাবা বসিয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। ইনস্টিটিউশন পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থার আগমন ঘটেছে। এই পদ্ধতির উত্সগুলো মুখস্থবিদ্যার প্রচলন। আমি যেটুকু জানি সেটুকুই শিক্ষা দেওয়া। ফলে ছাত্ররাও মুখস্থবিদ্যার আশ্রয়ে শিক্ষালাভ করে এবং এভাবেই গড়ে ওঠে এটা পরনির্ভরশীল শিক্ষাধারা। এতে মস্তিষ্কের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ হয় না। এই পদ্ধতি হচ্ছে চাকরিমুখী। ছাত্রদের প্রবণতা থাকে লেখাপড়া শেষ করে কীভাবে শুধুমাত্র একটা ভালো চাকরি পাবে, অর্থাত্ একটা অর্থ রোজগারের যন্ত্রে পরিণত হবে।
এর ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ও স্বার্থপরতা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে। আমাদের জানা দরকার, এডুকেশন পদ্ধতি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়, মানুষের চেতনার মানকে উন্নত করে, সৃষ্টিশীল চিন্তাধারাকে উজ্জীবিত করে, মানুষকে নতুন কিছু তৈরি করতে সাহায্য করে। মানবিক মূল্যবোধ তৈরি না হলে কল্যাণকর চিন্তাও আসবে না, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতাই কেবল বাড়তে থাকবে। তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের দেশে কি বিভিন্ন বিষয়ে যারা সাফল্য পাচ্ছে তারা নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের ক্ষমতায় পাচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি এ সমস্ত বিষয়ে অধিক মানুষের সাফল্যে সাহায্য করে, মানবিক মূল্যবোধকে বাড়িয়ে তোলে, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিতেই মানুষের মূল্যবোধ ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। মানুষ আর মানুষের কথা ভাবে না। তাই ফুটপাতে একটা অসুস্থ মানুষকে মরতে দেখেও আমরা সহযোগিতার হাত বাড়াই না, পাশ কাটিয়ে চলে যাই। কেন এমন হচ্ছে? যদি সমাজের মানুষের কথা না ভাবি তাহলে আমরা কি ভালোভাবে বাঁচতে পারব? এই নেতিবাচক শিক্ষা কখনো প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। শুধু বড় বড় ডিগ্রি পেলেই প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায় না। শিক্ষার সঙ্গে থাকতে হবে সংস্কৃতি, রুচিবোধ, মানবতাবোধ। তবেই তো সে শিক্ষা হয়ে উঠবে প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার জ্যোতি সমাজ ও দেশের মঙ্গল ঘটায়, মানুষের মঙ্গল করে, মানুষের কল্যাণ সাধিত করে।
আসুন এবার নিজের কাজকর্মের সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করে ফেলি। জীবনযাত্রার যে ব্যাপারগুলো বদলানো দরকার সেগুলো আগে ঠিক করে নেই। এবার নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কথা ভাবি। নিজের মনকে বলি, মানুষের সাহায্য ছাড়া আমাদের উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং মানুষের মঙ্গলময় দিকের কথাও ভাবতে হবে। আসুন মানুষকে ভালোবাসি, কারো দুঃখে ব্যথিত হই, সুখে আনন্দিত হই। সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস জন্মাতে সচেষ্ট হই। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, পারস্পরিক সহযোগিতায় গড়ে ওঠে সুন্দর সমাজ, সুন্দর জীবন।
লেখক: শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।