এর মাঝে একদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা সেদিন যা বলেছি তা আমার পাঠকদেরও জানাতে চাই যেহেতু আমি কিছু লেখালেখি করে থাকি। প্রথমে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার জন্ম না হলে হয়তো কোনদিনই আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না। স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদকে যারা জীবন দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। স্মরণ করেছি দুই লক্ষাধিক মা-বোন যারা সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য। সোমবার (১৯ আগস্ট) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবদুল মান্নান খান।
শ্রদ্ধা জানিয়েছি তাদের যাদের চিন্তা মনন ও নিরলস পরিশ্রমের দ্বারা গড়ে উঠেছে মহান প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বলেছি, জাদুঘর সব দেশে আছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সব দেশে নেই। এর প্রতিটি রন্ধ্রে রন্দ্রে রয়েছে শহীদের রক্ত। যুগে যুগে মাথা তুলে আমরা সবাইকে দেখাতে পারব এ অনন্য মহান কীর্তিটি। এর জন্য হাজার বার তাদের পদধূলি মাথায় মাখি যারা এটাকে আজকের এ অবস্থায় এনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছেন এর সমৃদ্ধি সাধনে। এ জাতি তাদের স্মরণে রাখবে চিরকাল।
এবার ওদের যা বলেছি সে কথায় আসি। যে দুটো কথা শেষে বলার ছিল সে দুটো কথা শুরুতে বলেছি। কারণ শেষে ভুলে যেতে পারি আবার সময়ের অভাবে নাও বলা হতে পারে তাই। প্রথম কথাটা হলো আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বলেছি, যখন স্কুলে লাইনে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে গাইবে তখন কখনও শুধু ঠোঁট মিলিয়ে যাবে না বা মিন মিন করে গাইবে না। একেবারে গলা ছেড়ে গাইবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এতে লাভ কী হবে সেটা পরে। দ্বিতীয় কথাটি বলার আগে বলেছি তোমরা কাগজ-কলম হাতে নাও। বানানটা বলে দিচ্ছি লিখ। আলেন গিনসবার্গ। ইনি একজন কবি। এবার লিখ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এটা ওই কবির লেখা একটা কবিতার নাম। ১৫২টা লাইন আছে ওই কবিতাটিতে যার প্রতিটা লাইনে ৫-৬টা করে শব্দ আছে। সহজবোধ্য ছন্দময় কবিতা। আমি এর দুটো লাইন তোমাদের পড়ে শোনাই- ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান/হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রে সান’।
একাত্তরে তিনি তার দেশ আমেরিকা থেকে এসেছিলেন, দেখেছিলেন পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত কান্ড এবং ফিরে গিয়ে লিখেছিলেন এ কবিতাটি। বলতে চাচ্ছি এ কবিতাটির কথা তোমরা মনে রাখবে এবং যখন সম্ভব হয় সংগ্রহ করে পড়বে। এর বাংলা অনুবাদ আছে। সুরারোপ করে গানও করা হয়েছে একাধিক ভাষায়। এ কবিতা এবং গান একাত্তরে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। দুনিয়ার বিখ্যাত সব গায়ক যেমন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, তাদের সঙ্গে পন্ডিত রবি শঙ্কর মিলে এ গানের ওপর আমেরিকায় কনসার্ট করে যে অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল তার সবটাই তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দান করেছিলেন। এ কবিতা পড়লে তোমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটা দিক পরিষ্কার হবে। যেমন পাকিস্তানিদের অত্যাচারে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ কীভাবে ঘরবাড়ি সবকিছু ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। শরণার্থী হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের হাজারও দিক রয়েছে। এ যুদ্ধটা এমন যুদ্ধ ছিল না যে দুই পক্ষে যুদ্ধ হলো এক পক্ষ হেরে গেল একটা ভূখ- স্বাধীন হয়ে গেল ব্যাপারটা তা নয়। এর গভীরতা অনেক দূর বিস্তৃত। এ কবিতাটি থেকে সে ধারণা তোমরা এখন না হলেও পরে করতে পারবে। সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহর ‘যশোর রোড ১৯৭১’ নামের বইটিতে অনুবাদসহ কবিতাটি আছে তোমরা খটুজে নিতে পার।
এবার এসো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তোমাদের কিছু শোনাই। ওই যে বললাম এর বিস্তৃতি অনেক দূর সেই আলোকে বলি। গ্রামের একটা অখ্যাত স্কুল থেকে বাষট্টির শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদ করে প্রথম রাজপথে নেমেছিলাম। সে কথায় না গেলাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কথা থেকে এসো শুরু করি। রাজপথে ঘটা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী আমি। অংশগ্রহণকারীও বলতে পার। নিশ্চয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কথা কিছু তোমরা শুনেছ। ঢাকার আসাদ গেটের নাম তোমরা শুনেছ দেখেছও হয়তো। ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি আসাদ যে মিছিলে গুলি খেয়েছিল আমি সেই মিছিলে ছিলাম। আসাদ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্র নেতা। তার স্মরণে ওই আসাদ গেট নাম। তার মৃত্যুতে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্র সমাজ। এর তিন দিন পর ২৪ জানুয়ারি আবার মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানিরা। এতে শহীদ হয় মতিউরসহ আরও কয়েকজন। মতিউর ছিল তোমাদের বয়সী। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল সে। ওই মিছিলে আমি মতিউরের থেকে বেশি দূরে ছিলাম না। মতিউরের কফিন আমি স্পর্শ করেছি এই হাতে।
সেদিন তাৎক্ষডুক ভাবেই উত্তাল হয়ে উঠল ঢাকাসহ সারা দেশের শহর-বন্দর। মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো ঢাকা। স্লোগানের নগরীতে পরিণত হলো ঢাকা। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’ জয় বাংলা’ এমন সব সেøাগানে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক। বঙ্গবন্ধু তখনও বঙ্গবন্ধু হননি তিনি জেলে। মওলানা ভাসানী ছাড়া আর সব বড় নেতা তখন জেলে। কেন জেলে! শেখ মুজিবের ছয় দফার দাবিতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কেঁপে উঠেছিল তাই সব নেতাকে জেলখানায় নিয়ে ভরেছিল। ছাত্রনেতারাই তখন আন্দোলনের পুরোভাগে। এ সময় সরকার কারফিউ দিতে লাগল। দিনে কিছু শিথিল হলেও সন্ধ্যা না হতেই কারফিউ। সেদিন ৩১ জানুয়ারি ’৬৯। সেই কারফিউ ভেঙে মিছিল বার করে ফেলে ঢাকার ছাত্রজনতা। আমি তখন শান্তিনগর ‘মোগল হাউস’ নামের একটা মেসে থাকি। রাত কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র হিসেবে নাম আছে। দুটো টিউশনি করি আর মিটিং-মিছিলে স্লোগান দিয়ে বেড়াই। রাজনীতির টোকাই যারে বলে আর কি। যেখানে মিটিং-মিছিল সেখানেই আমি। আমরা শান্তিনগর গ্রুপ। আমাদের গ্রুপটা ছিল ১নং শান্তিনগর (সচিবাস) কেন্দ্রিক। ওই এলাকায় এখন যেখানে স্কাউট ভবন তখন ওই জায়গাটা ছিল ফাঁকা। ছিল ইটের স্তূপ। আমরা ওই ইটের স্তূপের সাহায্য নিয়ে আলো-আঁধারিতে থেমে থেমে স্লোগান দিয়ে কারফিউ ভঙ্গের মিছিলে অংশগ্রহণ করি। অল্প কথায় সেদিনের কথা বলা কঠিন।
এলো ঊনসত্তরের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সবাই দেখল গণজাগরণ কাকে বলে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটা দেখলে তোমরা সেদিনের কথা কিছুটা ধারণা করতে পারবে। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেলেন শেখ মুজিব। সসম্মানে নিঃশর্ত মুক্তি। আইয়ুবশাহীর আর সাধ্য হলো না শেখ মুজিবকে আটকে রাখার। মুক্তির খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে দেখলাম, মানুষ সব দৌড়াচ্ছে। কেউ দৌড়াচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে, কেউ দৌড়াচ্ছে ৩২ নম্বরের দিকে, কেউ দৌড়াচ্ছে পল্টনের দিকে। কোথায় গেলে দেখা পাবে কেউ জানে না। শুধু দৌড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখবে বলে। ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে আর দেখা হলো না। পরের দিন দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি। মানুষ ছুটছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। সেদিন ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা প্রদানের জনসমুদ্রে ছাত্রনেতা (স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম পলিটিক্যাল সেক্রেটারি, এখন মন্ত্রী) তোফায়েল আহমেদ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করার প্রস্তাব করলেন। মানুষ দুই হাত তুলে সে প্রস্তাব সমর্থন করল। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার মাটি আমাকে ভালোবাসে আমিও বাংলার মাটিকে ভালোবাসি’। আজও সেকথা দুটো আমার কানে লেগে আছে।
এরপর আইয়ুব খান পদত্যাগ করলেন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করলেন। নির্বাচন দিলেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। শুরু হলো পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। নির্বাচনে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা বাহানা শুরু করল। সাড়ে সাত কোটি মানুষ তখন বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে আছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। লোক ধরে না রেসকোর্স ময়দানে। আমরা মেস থেকে সদলবলে দুপুর ১২টা বাজার আগেই সেখানে গিয়ে হাজির হই। সেই জনসমুদ্র সেদিন শুধু নেতার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল কী করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তোমরা নিশ্চয় শুনেছ। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণ এখন ইউনেস্কোর জরিপে বিশ্ব ঐতিহ্য তোমরা জানো আশা করি। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরপর এলো ২৫ মার্চের সেই কালরাত। নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা অস্ত্রশস্ত্র ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে। রক্তগঙ্গা বয়ে গেল ঢাকা শহরে। আমি এর দু’দিন আগে যশোরে আমার বাড়িতে যাই। কথা ছিল ২৬ তারিখ সকালে ঢাকায় রওনা দেয়ার। কিন্তু দেখি রেডিওতে আর ঢাকা ধরে না। পাওয়া গেল আকাশবাণী কলকাতা। ভেসে এলো দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ভারি কণ্ঠ ‘ঢাকায় ক্রাকডাউন হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি। ঢাকার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ গতকাল রাত ১২টা থেকে বিচ্ছিন্ন’।
ওই দিন রাত ১২টার পরে অর্থাৎ ২৬ তারিখ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা আটক করে নিয়ে গেল। অন্যান্য নেতাকর্মীরা ভারতে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি রেখে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। তাজউদ্দীন সাহেব হলেন প্রধানমন্ত্রী। এসব কথা তোমরা মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা বিভিন্ন বইতে পাবে। আর যশোর থেকে আমি কী দেখলাম। দেখলাম লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ছে। যার বর্ণনা তোমরা খুব ভালো ভাবে পাবে ওই সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটিতে। এরই একটা মিছিলের সঙ্গে আমি ভারতে যাই। ওরা শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই পায় আমি ফিরে আসি। আবার যখন যাই, শরণার্থী শিবিরে গিয়ে ওদের খোঁজ করি পাই না। কয়দিন এদিক সেদিক ঘুরে বাংলাদেশের মুখপত্র কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা দুই কপি সঙ্গে করে ঢাকায় ফিরে আসার মনস্থির করি। আসতে পথে মৃত্যুর মুখোমুখি পড়ে যাই। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বিপজ্জনক একটি মুহূর্ত ছিল সে।
সেদিন আমার বেঁচে ফেরার কথা ছিল না। কেন ওরা আমাকে ছেড়ে দিল ভাবতে পারি না। ঘটনাটা ছিল এরকম, গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ফেরি ছেড়ে এসে ভিড়ল আরিচা ঘাটে। ভিড়তে না ভিড়তে লাফ দিয়ে ডাঙায় পড়ে দিয়েছি দৌঁড়। উদ্দেশ্য সবার আগে ইপিআরটিসির বাস ডিপোতে পৌঁছে (এখন বিআরটিসি) ঢাকার বাসের টিকিট সংগ্রহ করা। ইতোমধ্যে যে ওই বাস ডিপো হয়ে গেছে মিলিটারি ক্যাম্প তাতো আর আমি জানি না। মাই গড! সমানে দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছি ক্যাম্পের ভেতর। হলট না কি যেন একটা বিকট শব্দ হলো। দেখি তিন দিক থেকে আমার দিকে রাইফেল তাক করা। হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল যার ভেতর জয় বাংলা পত্রিকা। সঙ্গে সঙ্গে আমি ইংরেজিতে দ্রুত কথা বলা শুরু করলাম।
কী করে যেন মাথায় এটা এসেছিল। বলতে লাগলাম, আমি জানতাম এখানে বাস ডিপো ছিল আমি বাস ধরে ঢাকায় যাব বলে এখানে এসেছি। আরও যা যা মনে এসেছে কোন রকম থামাথামি নেই, বলে যেতে থাকি উচ্চস্বরে। টিনশেড লম্বা টানা বারান্দা অনেকগুলো দরজা। আমি বারান্দার সামনে খোলা জায়গাটায় দাঁড়ানো। শুনলাম ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, উসকো পাকড়াও এধারছে। এ সময় অন্য দরজা দিয়ে একজন বেরিয়ে এসে (ওদের বড় কর্তা হবেন পরে ধারণা করেছি) ইশারা করলেন চলে যাও। আমি ব্যাগটার দিকে তাকালাম। ইশারা করলেন ওটা নিয়ে যেতে। ব্যাগটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম পা বাড়ালাম অপেক্ষা করতে লাগলাম গুলির। না, দেখলাম বেঁচে আছি। বন্ধুরা তোমরা কী বুঝলে, যে কারণে হোক গুলি করে বা টর্চার সেলে নিয়ে আমাকে ওরা পিষে মারেনি ঠিক কিন্তু আমার মতো লক্ষজনকে নির্মমভাবে ওরা হত্যা করেছে। সেদিন আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ভাবছ ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ মোটেই তা নই।
যাহোক ঢাকায় এক আত্মীয়র বাসায় উঠলাম। বাসার কাজের ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করল বাড়ি যাবে বলে। কেউ নেই বলে বাসাটা ফেলে সে যেতে পারছে না। খবর এসেছে ওর আপনজন কাওকে ধরে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। ও চলে গেল। আমি একেবারেই একা বাসায়। পত্রিকা দুটো এসেই দুই জায়গায় কায়দা করে রেখে এসেছি যাতে মানুষের হাতে পড়ে। পথে রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানা বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে ঢাকা পর্যন্ত আনতে পেরে একটা কিছু করতে পেরেছি এমন উৎসাহ তখন মনে। পরের দিন বিকালে গেটে কড়া নাড়লে গিয়ে দেখি কয়েকজন ইয়াং হুজুর। জানতে চাইল বাসার মালিক কই। বললাম তারা ঢাকার বাইরে আমি আছি শুধু। একজন বলল, এ বাসায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা হয় বলে আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে। সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি আর যেন না শোনা হয়। ওরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চলে গেল। দেখলাম বিপদ তো ঘনিয়েছে। ওই ছেলেটা হয়তো শুনত। গত দু’দিন আমিও শুনছি। বুঝলাম ওরা আবার আসবে এবং আমাকে ছাড়বে না। এর পরের ঘটনা বলতে গেলে অনেক খানি আরও লিখতে হবে। সেটা এখানে সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিক্ষার্থীদের বলেছি আমি কীভাবে ওই বাসার বন্দুক নিয়ে রাজাকার মারব বলে উদ্যত হয়েছিলাম। শেষে মারা বা মরা কোনটাই হলো না। ওরা আর পরের দিন আসেনি আমিও ওখানে আর থাকিনি।
তখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারত নয় মাস আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে থাকতে-খেতেই দেয়নি শুধু, মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে। ভারত নিজে সবার আগে ৬ ডিসেম্বর ’৭১ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকা চীন সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম রাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনয়নকে পক্ষে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নিয়ে। মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী এক হয়ে গঠিত হয় যৌথবাহিনী। সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী। বাংলাদেশ লাভ করে চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য আমি রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখেছি। যে মুহূর্তে তিনি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরের জন্য মাথা নত করেন তখনই উপস্থিত কয়েক হাজার দর্শকের জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
এরপর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি ’৭২ সালে।
এসবের সঙ্গে যেকথাটা বলেছি, মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হলে বুঝতে হলে তোমাদের পড়তে হবে। জানার জন্য পড়ার কোন বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা অসংখ্য বই আছে লাইব্রেরিগুলোতে। তোমরা পছন্দমতো বই খুঁজে নিয়ে পড়বে। ওদের সামনে যা বলেছি তা এখানেও বলছি। আমার লেখা বইটিও ওদের পড়ে দেখতে বলেছি। বইটার নাম ‘১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী’।
এরপর ওদের সঙ্গে আমার প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়। দেখলাম ওরা লিখে এনেছে অনেক প্রশ্ন। আমার খুব ভালো লেগেছে প্রশ্নগুলো শুনে। আমার নাম-ঠিকানা, বয়স-পেশা, কী করি না করি, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছি, কোথায় অস্ত্র জমা দিয়েছি এরকম কত প্রশ্ন। এর মধ্যে চারটা প্রশ্ন ছিল এরকম ১. বঙ্গবন্ধুকে আপনি প্রথম কখন কোথায় দেখেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন স্মৃতি আছে কিনা ২. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আপনি পড়েছেন কিনা।
পড়ে থাকলে কোন জায়গাটার কথা বলবেন ৩. পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এ ঘটনাকে আপনি কী বলবেন ৪. মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সমর্থন করেন কিনা। অনেকগুলো প্রশ্নের হ্যাঁ-না বা ২-৪ কথায় জবাব দেয়া গেছে। যা বলেছি সেটা এরকমÑ কোন ট্রেনিং নেইনি, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করিনি, অস্ত্র জমা দেয়ার প্রশ্নও আসেনি। তারপর ওই ৪টা প্রশ্নের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছি ’৬২ সালে হবে আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি যশোর টাউন হল ময়দানে ভাষণদানরত অবস্থায়। বলতে পারিনি যশোর শহর থেকে ১৭ মাইল দূরের এক অজপাড়াগায়ের স্কুল থেকে কীভাবে গিয়েছিলাম আর কীভাবেই বা ফিরে এসেছিলাম। বলতে পারিনি বঙ্গবন্ধুকে কী বলতে শুনেছিলাম। সেসব কথা বলতে গেলে বইয়ের পৃষ্ঠার মতো দুটো পৃষ্ঠা অন্তত লাগবে। ২ নম্বর প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের জবাব দিতে আমাকে একটু থেমে যেতে হয়েছিল। পুরা বইটাই আমার অসাধারণ ভালো লেগেছে। কোন অংশের কথা বলব।
বইটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় আমি একেবারে শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। জায়গাটা হলো ১০৩-১০৪ পৃষ্ঠার ধান কাটা বিষয়। গোপালগঞ্জের দিনমজুররা ধান কাটার মৌসুমে বিভিন্ন জেলায় বেশ বড় বড় নৌকা নিয়ে ধান কাটতে যেত যাদের গোপালগঞ্জের লোকেরা ‘দাওয়াল’ বলত। ওরা আমাদের যশোরও যেত। চিত্রা নদীর পাড়ে আমার বাড়ি। ওরা আমাদের ঘাটে নৌকা বেঁধে মাস ভর ধান কেটে ফিরত। আমাদের ওখানে ওদের বলত ‘আঁটিভাগা’। ২০ আঁটি ধান কেটে দিয়ে ওরা এক আঁটি নিত তাই ওদের বলতো আঁটিভাগা। সেই ছোট বেলায় শুনতাম ওরা যে আঁটিটা নিত তাতে ধান বেশি থাকত। আমি তখন ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ডাঙ্গায় বড় পাটি পেড়ে তার ওপর ওই ধানের আঁটি ফেলে দুই পা দিয়ে মাড়াতে।
তারপর রোদে শুকিয়ে সে ধান নৌকার গলুইয়ে জমা করতে। ছোট বেলার কথা। স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতিতে একেবারেই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সেই আঁটিভাগাদের কষ্টার্জিত ধান নিয়ে ফিরে যাওয়ার পথে সরকারের অনাচারের কথা পড়ে খারাপ লেগেছে। ওদের আমি খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম। এ ঘটনার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিÑ মনে মনে বলেছি এজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু এজন্যই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এজন্যই তিনি জাতির জনক। ঘটনাটা সেদিন শিক্ষার্থীদের সামনে বলতে পারিনি। শুধু বলেছি ধানভাগা অংশ। কথাটা বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না আশা করি। ৩ নম্বর প্রশ্নের জবাবে বলেছি সভ্য জগতের ইতিহাসে এটা জঘন্যতম ঘটনা। এমন নৃশংস ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই। একই সঙ্গে বলেছি এটা সেই আগস্ট মাস আমাদের জাতীয় জীবনে শোকের মাস। আমরা শোকাহত। ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলেছি অবশ্যই এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চাই।