শুধু পাঠ্যবইয়েই নয়, শিক্ষার্থীদের বিচরণ করতে দিতে হবে কল্পনার জগতেও - দৈনিকশিক্ষা

শুধু পাঠ্যবইয়েই নয়, শিক্ষার্থীদের বিচরণ করতে দিতে হবে কল্পনার জগতেও

বিজ্ঞাপন প্রতিবেদন |

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তক পাঠই নয়, আনুষঙ্গিক শিক্ষাসহ আনন্দ ও মনোযোগ দিয়ে পাঠ। তাই শিক্ষার্থীদের প্রকৃতরূপে জ্ঞানী করে গড়ে তুলতে চাইলে কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না; তাদেরকে বিচরণ করতে দিতে হবে জ্ঞানের মহা সমুদ্রে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,

‘হাওয়া খেলে পেট ভরে না আহার করলে ভরে,

আর আহারকে হজম করার জন্য কিছু কিছু হাওয়া খাওয়া প্রয়োজন।’

শিক্ষার্থীরা যাতে বিভিন্ন সহশিক্ষার মাধ্যমে দীক্ষিত হয়ে আনন্দ নিয়ে পাঠ করার মাধ্যমে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাব আত্মস্থ করার মাধ্যমে তাদের চিন্তাশক্তির প্রসার ঘটাতে পারে এবং তাদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় সেদিকেই একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একজন শিক্ষক যদি তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে চান তবে তাঁকে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে নিয়ে এসে আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির কলাকৌশল ও উন্নত শ্রেণি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে হবে। তবেই না একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষকতা জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারবে।  

একজন সার্থক শিক্ষকের প্রধান কিছু বৈশিষ্ট্য-

  • স্থির সঙ্কল্পের হওয়া।
  • নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীদের বন্ধু হওয়া।
  • পাঠদান প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের জীবনের সঙ্গে যাতে প্রাসঙ্গিক হয় সেদিকে গভীর নজর দেওয়া।
  • শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাটানো সময়কে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করা।
  • পড়ানোর সময় বেশি বেশি উদাহরণ দিয়ে পড়ানো।
  • পড়ানোর বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা।
  • নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে থাকা।
  • শিক্ষার্থীদের সামনে প্রতিটি কাজেরই একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য উপস্থাপন করা।
  • নিজেকে শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা।  
  • শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস করা।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর দিকে যদি গভীর নজর দেওয়া যায় তবেই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সঠিক শিক্ষাদান করতে সক্ষম হবেন, যেটা শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভর পড়াশোনা করিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠ্যপুস্তকেও নিহিত রয়েছে অজস্র জ্ঞানের সামগ্রী। কিন্তু তা শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে সঠিক নিয়মে। সেক্ষেত্রে মুখস্ত নির্ভর পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি না করে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল উপায়ে পড়াশোনা করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর তার জন্য প্রধানত চাই হাসিখুশি এবং সুশৃঙ্খল ক্লাসরুম। কারণ হাসিখুশি ভরা একটা ক্লাসরুম শিশুদের পড়াশোনা, তাদের অনুভূতি এবং সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। ক্লাসরুমের পরিবেশ যদি ভালো হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ অনেক বৃদ্ধি পায়। তবে, কিছু বিষয় তো মুখস্ত করতে হবে এবং আজীবন তা চালিয়ে যেতে হবে।    

ইতিবাচক শ্রেণিকক্ষ বা ক্লাসরুম তৈরি এবং সঠিক উপায়ে শিক্ষাদান করতে একজন শিক্ষক কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারেন

  • ছাত্রছাত্রীরা যখনই ভালো কোন কাজ করে বা আচরণ করে তৎক্ষণাৎ তাদের প্রশংসা করা এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করার জন্য তাদের উৎসাহ দেওয়া।
  • একজন ছাত্রের মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি, তার জীবনযুদ্ধে লড়াই করার কৌশলের বিকাশ ঘটানো অর্থাৎ তাদের আবেগঘটিত সমস্যা ও অন্যান্য নানা সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করা।
  • একজন শিক্ষার্থীর জীবনে চাই যথেষ্ট নিরাপত্তা এবং বড়দের যথাযথ যত্ন। আর নিজের সীমারেখা জানা থাকলে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, যত্ন এবং কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা সীমারেখা তৈরি করে দিলে তারা নিজেদের অনেক বেশি নিরাপদ মনে করবে।
  • শিক্ষাদানের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মিলিত অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো করে শেখাতে চান তাহলে শিক্ষার্থীরা শেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। এক্ষেত্রে হাওয়ার্ড গার্ডনার-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে-

‘একটা বাচ্চা কতটা শিখল তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সেই শেখা সে কীভাবে প্রয়োগ করছে।’

  • একজন ছাত্রের দোষ অন্য আরেকজন ছাত্রের ঘাড়ে চাপানো চলবে না। শিক্ষকের উচিত চোখ-কান খোলা রেখে দেখা এবং শোনা ও নিজের যথাযথ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান করা।
  • যে শিক্ষক জ্ঞানী, তাঁর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তিনি খুব সংগঠিত হন, আচরণে আত্মবিশ্বাসী থাকে এবং যে কোনরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাঁর থাকে। শিক্ষক তাঁর চিন্তা এবং মানসিক উদারতা দিয়ে সমগ্র বিরূপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তাই শ্রেণিকক্ষকে সুশৃঙ্খল করে পাঠদানকে কার্যকরী করে তুলতে চাইলে একজন শিক্ষকের এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি।

 

পাঠ্যবইয়ের মধ্যে থেকেই শিক্ষার্থীদের ঘুরিয়ে আনতে হবে কল্পনার জগত থেকে এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে তৈরি করতে হবে পাঠ্যবই ও বাস্তব জীবনের সেতুবন্ধন যেমন-

পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সেতুবন্ধন: কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয় সরাসরি বই থেকে না পড়িয়ে বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে বাস্তব জীবন থেকে উদাহরণ দিয়ে পড়াতে পারলে শিক্ষার্থীরা পাঠে অধিক মনযোগী হবে এবং আনন্দ সহকারে পড়াশোনা করবে।

খেলাধুলার আয়োজন করা: হতে পারে ইতিহাস ক্লাস, পাঠ্যসূচিতে শিক্ষার্থীদের সন-তারিখ মনে রাখা অংশটি রয়েছে। সেক্ষেত্রে মেমোরি গেম খেলা যেতে পারে; শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে, যে সবচেয়ে বেশি সাল-তারিখ মনে রাখতে পারবে তার স্মৃতি তত ভালো। শিক্ষকও অংশ নিতে পারে খেলায়, হেরে যেতে পারে ইচ্ছে করেই। দেখা যাবে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে হারাতে বা সহপাঠীদের নাস্তানাবুদ করতে করতেই অনেক সাল-তারিখ শিখে ফেলেছে।

কেবল উত্তরদাতার ভূমিকায়ই নয়, শিক্ষার্থীদের প্রচুর প্রশ্ন করার পরিবেশ ও সুযোগ দিতে হবে: এমন করা যেতে পারে, ক্লাসে যে বিষয়টি পড়ানো হবে সে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের যত প্রশ্ন আছে তা করতে বলা হল। তারপর কিছু উত্তর শিক্ষক নিজে দিলেন, কিছু উত্তর শিক্ষার্থীদেরই করতে উৎসাহিত করলেন। তারা নিজে বা সহপাঠীর সাহায্য নিয়ে কিংবা শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে হলেও উত্তরটি বের করলো। এতে করে শিক্ষার্থী পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।   

শিক্ষার্থীদের হাতে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া: শিক্ষক নিজে যে টপিকটি পড়াবেন বলে ঠিক করে এসেছেন সেটা হয়তো ওইদিনের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়তে ইচ্ছে নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যদি দশটি বিষয় দেওয়া হয়, বেছে নিতে বলা হয় যেকোনো একটি এবং সেই বিষয়ের ওপর ক্লাস নেন। এতে ক্লাসে যেমন মজার এবং সুন্দর একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে, ঠিক সেভাবে শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়ে ক্লাস নিলে তাদের মনোযোগও পাওয়া যাবে সহজে।  

তাছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের পরিধি আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রাণবন্ত আমরা তখনই হই যখন আমাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস থাকে, বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকে, কল্পনা শক্তি ও সৃজনশীলতা থাকে। যখন পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আমরা পড়াশোনা করি তখন এই মানসিক শক্তিগুলো পেয়ে থাকি। তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য গল্পের বই পড়ার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যেমন-

  • মানসিক চাপ কমায়
  • মনোযোগ বাড়ায়
  • অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়
  • শব্দ ভান্ডার বাড়ায়
  • আত্ম-উন্নয়ন ঘটায়

শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং তার প্রতিভা বিকাশে সামাজিক পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুস্থ-সুন্দর সামাজিক পরিবেশ শিশুর মেধা ও মননশীলতা বিকাশে অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের মনে সুকুমার বৃত্তির অনুশীলনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাদের মধ্যে শ্রমশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্য, নিজ ও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং অধ্যাবসায়ের অভ্যাস গঠন; কুসংস্কারমুক্ত, দেশপ্রেমিক ও কর্মকুশল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে একজন শিক্ষক রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেখানে শুধু পাঠ্যপুস্তকই যথেষ্ট নয়; শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের নিজস্ব কল্পনার জগতে বিচরণ করে এবং বাস্তব জীবন থেকে শিখতে পারে সে দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076999664306641