বৃহস্পতিবার ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন। এ বাজেটে শিক্ষার অবস্থান কোথায় থাকবে? শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে, শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কী ধরনের প্রস্তাব থাকবে? কী সুসংবাদ থাকতে পারে?
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাত উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ পাচ্ছে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মিলে বরাদ্দের পরিমাণ ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। টাকার হিসাবে চলতি বাজেটের চেয়ে ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। আবার ৯ বছর ধরে আটকে থাকা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জট সরকারের শেষ বাজেটে খুলতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, কত প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তা চূড়ান্ত করছে। শিক্ষায় নাকি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে- শিক্ষার অবকাঠামোর উন্নয়নে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগে (ইইডি) : ১৬১২ কোটি ৮ লাখ টাকা।
শিক্ষক নেতাদের অবস্থান
শিক্ষক নেতারা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে যেসব প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখতে চান তার মধ্যে রয়েছে- ১. শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ; ২. সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা; ৩. বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা প্রদানের পরিবর্তে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ পেনশন চালু; ৪. নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানকারী শিক্ষকসহ বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তি; ৫. কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি কারিগরি ও ভোকেশনাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; ৬. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিতকরণ ইত্যাদি।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর পক্ষে ভাবনা
অভিভাবকরা তার সন্তান অথবা পোষ্যের কল্যাণে কী চান, কী ভাবেন, তা নিয়ে আমাদের দেশে খুব একটা অনুসন্ধান চালানো হয়নি। গ্লোবাল প্যারেন্টস সার্ভে ২০১৭ থেকে জানা যায়, অভিভাবকরা শিক্ষকের উন্নয়ন ও মর্যাদাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে আগ্রহী। সন্তানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করেন মানসম্পন্ন শিক্ষক দেখে।
২৯টি দেশ নিয়ে এ জরিপ পরিচালিত হয়। আমাদের দেশে এখন শিক্ষার্থীর উন্নয়নের প্রসঙ্গে অভিভাবক আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। মায়েদের উদ্যম এ ক্ষেত্রে
বেশি। তবে শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত আদেশ-নির্দেশ পালনে যতটা অভ্যস্ত, তাদের কিসে সুবিধা-অসুবিধা, তা নিয়ে সরব হতে শেখেনি। স্টুডেন্ট কেবিনেটের মতো উদ্যোগ নাড়া দিলেও খোদ শিক্ষার্থীর জড়তা এখনও ভাঙেনি। এ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন একটা অনুসন্ধানও হয়নি। তবে তা হওয়া দরকার।
শিক্ষা বরাদ্দ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকা উচিত। কারণ শিক্ষায় ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি মানেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত যে, শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ, যা থেকে ক্রমাগতভাবে দেশ ও জাতি উপকৃত হয়। তবে শিক্ষা খাতের বাজেট ঘোষণাই বড় কথা নয়, বাজেট কীভাবে ব্যয় হবে, সেটিই বড় কথা। শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বড় অভাবটি হচ্ছে শিক্ষার গুণ ও মান। ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণমান নিশ্চিত করা যায় না। বরং গুণ ও মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ বা প্রশাসনে গুণমান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন হতে পারে। শিক্ষা খাতের কোনো কিছুই যেন রাজনীতিকীকরণ করা না হয়। তাহলেই কেবল শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো সার্থক হবে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, শুধু বাজেট বাড়ানোই নয়, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দটা শিক্ষা খাতে দেয়া উচিত।
কারণ শিক্ষা খাতের সঙ্গে যুক্ত সব মন্ত্রণালয় ও দেশের সব উন্নয়ন। শিক্ষা খাতকে যদি বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া না হয়, তাহলে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ব। অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, সব শিক্ষক অবসর গ্রহণের পর যেন সময়মতো তাদের পেনশনের টাকা হাতে পেয়ে বাকি জীবন অন্যের ওপর ভরসা না করে ভালোভাবে চলতে পারেন। বাজেটের অপচয় রোধে অর্থবছরের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান। তার মতে, বর্ষাকাল শুরুর আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা উচিত। আমাদের দেশে অর্থবছরের শুরুর দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি থাকে এবং অর্থবছরের শেষদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের হিড়িক পড়ে। এতে জাতীয় অর্থের ব্যাপক অপচয় ঘটে। প্রকল্পের সঠিক মানও বজায় রাখা যায় না। তিনি শিক্ষা ও গবেষণা বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন।
একজন লেখকের ক্ষোভ
একটি জাতীয় দৈনিকে সম্প্রতি একজন লেখক ক্ষোভের সঙ্গে তার কলামে লিখেছেন : ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম অথচ সামরিক-বেসামরিক আমলাদের জন্য বরাদ্দ করতে টাকার কোনো সমস্যা হয় না। ডেপুটি সেক্রেটারির গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মাসে ৫০ হাজার টাকা, যুগ্ম সচিবদের জন্য মোবাইল ফোন কেনা বাবদ ৭৫ হাজার টাকা, বাবুর্চি-দারোয়ানের জন্য মাসে ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হল বাজেটের আগেই। অথচ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ কম, এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষকরা রাস্তায়, গ্রাম পুলিশরা ৩৪০০ টাকা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, কৃষক ধানসহ ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না।’
আমার ভাবনা ও প্রত্যাশা
আমি আশাবাদী মানুষ। শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্জনে বিভিন্ন সময়কালের ধারাবাহিকতা মেনে নিয়েও স্বীকার করি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তিনটি সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও সাফল্য রয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও দক্ষতা উন্নয়ননীতি ২০১১ প্রণয়নে, শিক্ষার্থীদের বিকাশে বিভিন্ন বাধা অপসারণে ও শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে তার ভূমিকা ও সময়োচিত হস্তক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তবে এ কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে পুরনো সব সমস্যার নিরসন হয়েছে অথবা নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়নি। তবে লক্ষ করেছি, কোনো সমস্যা সংকটে রূপ নিলে অথবা প্রকট হয়ে দেখা দিলে কোনো না কোনো সমাধানসূত্র তার নির্দেশনায় বের হয়ে আসে। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে শিক্ষার্থীর কল্যাণ-ভাবনা প্রধান বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ ও কর্মপরিবেশে সন্তুষ্ট শিক্ষকের অপরিহার্যতা এবং তার সব যৌক্তিক প্রত্যাশার প্রতিফলন একান্ত কাম্য। ২. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি ও বিজ্ঞানাগার সমৃদ্ধকরণের নির্দিষ্ট উদ্যোগ ও পরিকল্পনার জন্য সহায়ক অর্থ বরাদ্দ। ৩. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবকাঠামো যাচাই, উপযোগিতা নির্ণয় করেই শিক্ষার্থীর উন্নয়ন সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ। ৪. সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে শিক্ষকদের সৃজনশীল পাঠদানের সক্ষমতা অর্জনে অব্যাহত প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ। ৫. সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে শিক্ষকদের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধিতে সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণ, যার মধ্যে বিনোদন সহায়তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ৬. শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন উদ্ভাবনে, আবিষ্কারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা তহবিল গঠন।
প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
সরকার ও শিক্ষকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করি। শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে তার পাঠ্যপুস্তক যুগোপযোগী ও পাঠদান আনন্দময় না করে, খেলার মাঠের ব্যবস্থা না করে, পাঠদানকারী শিক্ষকের যথোচিত প্রত্যাশা পূরণের বিষয়কে পাশ কাটিয়ে দালানকোঠার কলেবর বাড়িয়ে আর যাই
হোক, বিশ্বমানের শিক্ষা অথবা এসডিজি-৪ বাস্তবায়ন যে সম্ভব নয়, শিক্ষা কর্মকর্তাদের তা উপলব্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকতায় প্রবেশকালের যোগ্যতা যে স্থায়ী কোনো যোগ্যতার বিষয় নয়, আমাদের শিক্ষকদেরও তা অনুধাবন করে অব্যাহত দক্ষতা অর্জন ও বিশ্বায়নে অবারিত নানা শিক্ষাতথ্য-অভিজ্ঞতায় নিজেকে হালনাগাদ রেখেই শিক্ষার্থীর তুলনায় অন্তত এক ধাপ এগিয়ে থাকতে সচেষ্ট হতে হবে। শিক্ষকদের পক্ষে যারা কথা বলেন, শিক্ষকদের দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসেন, তাদেরও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। সরকার তো তাদের অবস্থান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে, যা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে এ কর্মসূচিকে নির্দিষ্ট সময়সীমার অধীনে প্রকাশ্য নীতিমালার ভিত্তিতে আরও কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, শিক্ষকদের পেশাগত সংগঠনগুলো থেকে সে লক্ষ্যে নির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ রাখা দরকার। সরকারীকরণ ও জাতীয়করণ যে এক নয়- এখন পর্যন্ত তা-ই বা ক’জনের কাছে স্পষ্ট?কোনো বাজেট প্রস্তাবেই সব প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার নজির নেই। তবে এ কথা মানতে হবে, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা বিগত বাজেটে আশাহত হয়েছেন। দেখার বিষয় এবারের বাজেট তাদের জন্য কী কী সুসংবাদ নিয়ে আসে? আমি আশাবাদী। তবে আশা-নিরাশার অনুপাত দেখতে আমাদের সবাইকে ৭ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, প্রবীণ শিক্ষক নেতা
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর