আমাদের শিক্ষাঙ্গনে যে সভ্যতার চরম সংকট বিরাজ করছে, বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ সতীর্থদের হাতে জীবন দিয়ে জাতিকে সেই বার্তা দিয়ে গেলেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের জের ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের পরিচয় বহনকারী কতিপয় শিক্ষার্থী আবরারকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। এ বীভৎস ঘটনায় জাতি বিস্মিত হয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অভিভাবক, সুশীল সমাজসহ সচেতন নাগরিক সমাজ। ভিন্নমত দমনের এ নারকীয় কৌশলকে কেউই মেনে নিতে পারছেন না। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি শৃঙ্খলাবোধ ও চরিত্র গঠনের জন্য যে বিদ্যাপীঠে প্রবেশ, সেই বিদ্যাপীঠের এহেন অবস্থাকে সভ্যতার সংকট হিসেবে দেখছেন অনেকে।
আর এ সংকটের কারণ হিসেবে উঠে আসছে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কথা।
সর্বোচ্চ এসব বিদ্যাপীঠে প্রবেশকারী মেধাবী শিক্ষার্থী এবং মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের একাংশের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিত্তবৈভবের বিলাসিতা আজ দেশব্যাপী আলোচিত বিষয়।
সাম্প্রতিককালে মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জাতির সামনে এসব অপকর্ম ও কুকীর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে ওঠে এসেছে রাজনীতি, গণতন্ত্র ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে নানা মতামত ও সমালোচনা। উঠে এসেছে এসবের রাশ টেনে না ধরা গেলে ভয়ঙ্কর পরিণামের ইশারা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি সর্বজনবিদিত- ‘তোমার মতের সঙ্গে আমার দ্বিমত থাকতে পারে; কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারি।’
আসলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু জন্মগত অধিকার নয়, আমাদের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে এর স্বীকৃতও দেয়া হয়েছে।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি- গতকাল যেমন আজকের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তেমনি আজও কিন্তু আগামীকালের নিয়ন্ত্রণে। এটিই অমোঘ সত্য। তবে ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। এসব কারণেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সূর্য ডোবার প্রাক্কালে জীবনের শেষ অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ সতর্কবার্তা ও হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে- অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি / ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিপক্ষ দমনে নিপীড়ন-নির্যাতন কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আবরার ফাহাদের নির্মম পরিণতিই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং এ ধরনের কোনো অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এমন আকুতিই শান্তিপ্রিয় নাগরিক সমাজের সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক) স্ট্যাটাসে উঠে এসেছে।
দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। উচ্চারিত হোক ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ সেথা শির’। এ আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাক।
এ টি এম নিজাম: সাংবাদিক