চাকরি বিশেষ করে সরকারি চাকরি যেন সোনার হরিণ। অনেকেই যথেষ্ট মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরি পান না সহজে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ঢোকার পথ কিছুটা সহজ হলেও বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডার সার্ভিস তথা সরকারি চাকরিতে অনুপ্রবেশ বেশ কষ্টাসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। ফলে স্বভাবতই প্রায় ২৪ লাখ শিক্ষিত বেকারের অনেকের মধ্যে হতাশা থাকা বিচিত্র নয়। এবার সেটা আরও কিছুটা কঠিন তথা দুঃসাধ্য হতে চলেছে। সরকারি চাকরিতে ঢোকার শর্ত হিসেবে ডোপ টেস্ট তথা মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এর জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জেল-জরিমানাসহ অর্থদণ্ডের বিধান রেখে প্রণয়ন করেছে ডোপ টেস্ট বিধিমালা-২০১৯। বলা বাহুল্য, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে পাওয়া যাবে না সরকারি চাকরি। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কেউ আবেদন করলে তাকেও উত্তীর্ণ হতে হবে এই পরীক্ষায়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণদের একাংশের নীতিনৈতিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। সেই প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। রোববার (২৯ ডিসেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বর্তমান সরকার জঙ্গীবাদ ও মাদক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে অনেক আগেই। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাবতীয় দুর্নীতি, অপকর্ম ও অপরাধের ক্ষেত্রেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে শতভাগ সাফল্য এসেছে, এমন বলা যাবে না। তবে রাঘববোয়ালদের ধরা পড়তে দেখা যাচ্ছে। দেশে জঙ্গীবাদ নির্মূল না হলেও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিসহ ক্রসফায়ারে তিন শতাধিক মাদক কারবারি ও চোরাচালানি নিহত হলেও মাদক, বিশেষ করে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। ইয়াবা আসছে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তপথে। অভিযান চালাতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, ইয়াবা চোরাচালানসহ এর ব্যবহার দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি সীমান্তরক্ষীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই জড়িত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এহেন অবস্থার অবসানকল্পে সরকারি চাকরিতে প্রবেশসহ চাকরিরতদের জন্য ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু অনুশাসনও দিয়েছেন।
ইতোপূর্বে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সরকার প্রণয়ন করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা-২০১৭’। এর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সরকারি চাকরিরতদের শুদ্ধাচার চর্চায় উৎসাহ প্রদান। ব্যক্তি ও চাকরিজীবনে শুদ্ধাচার চর্চার নানাদিক রয়েছে। এর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮টি সূচক, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, নীতিনৈতিকতা, আদর্শ, কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, দায়িত্বশীলতা, সহকর্মী ও অধঃস্তনদের প্রতি আচরণ, সেবা গ্রহীতার প্রতি আচরণ, ঘুষ-দুর্নীতি পরিহার, মিতব্যয়িতা, উদ্ভাবন চর্চা ইত্যাদি। কোন চাকরিজীবীর গুণাবলীর সূচকের বিপরীতে প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও নির্বাচিত করা হবে সেরা কর্মকর্তা-কর্মচারী। পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেয়া হবে। শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদ এবং অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক মান ও দক্ষতা ভালো নয়। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-মাদকাসক্তি প্রায় সর্বত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এসব অনিয়ম-অনাচার-দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা অনতিবিলম্বে দূর করতে হবে। সরকারের নবপ্রণীত বিধি ডোপ টেস্টসহ শুদ্ধাচার পুরস্কার যদি এসব ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়, তাহলেই এর সাফল্য ও সার্থকতা।